ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় রসিকতা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি রাঁধুনিকে রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। ভবিষ্যতে ভারত এমন কিছু করলে আগে জানানোর জন্যও বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শুক্রবার নয়াদিল্লিতে আইসিটি মৌর্য হোটেলের কামাল মহল হলে ভারত-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামের (আইবিবিএফ) উদ্বোধনী অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা হিন্দিতে বলেন, ‘হঠাৎ করে আপনারা বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছেন। আগে নোটিশ দিলে আমরা অন্য দেশ থেকে ব্যবস্থা করতে পারতাম। ভবিষ্যতে এমন কিছু করলে আগে জানালে ভালো হয়।’ শেখ হাসিনা তাঁর বাসায় রাঁধুনিকে রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন বলেও রসিকতা করে জানান।
প্রসঙ্গত সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম প্রতিকেজি ১১০ থেকে ১২০ টাকায় উঠে।
বাংলাদেশ ও ভারত বর্তমানে সর্বকালের সেরা সম্পর্ক উপভোগ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের নিজ নিজ জনগণের পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করে এই অঞ্চলকে আরও সমৃদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের সকলকে প্ল্যাটফর্মটির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে এবং আমাদের জনগণের পারস্পরিক বৃহত্তর স্বার্থে উভয় দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার অনুরোধ করছি এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশ ও এই অঞ্চলকে আরও সমৃদ্ধ এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারব।’
আইবিবিএফের প্ল্যাটফর্মের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক উপভোগ করছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আপনাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্ল্যাটফর্মটি রয়েছে এবং আমরা আপনাদের প্রচেষ্টা সহজ করার জন্য সকল ধরনের সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী ভারতের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কগুলোতে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বেশ কয়েকটি হাইটেক পার্ক প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগের জন্যও প্রস্তুত রয়েছে। মোংলা, ভেড়ামারা ও মিরসরাইয়ে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য তিনটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই তিনটি ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আমাদের রপ্তানিযোগ্য খাতকে আরও প্রশস্ত করতে সহায়তা করবে।’ ‘আমরা সারা দেশে এক শ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছি, যার মধ্যে প্রায় ১২টি তৈরি হয়ে গেছে যেখানে ৪টি অঞ্চল ৩টি দেশের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে’, যোগ করেন তিনি।
এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান দেশটিকে এই অঞ্চলের অর্থনীতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমে ভারত, উত্তর দিকে চীন এবং পূর্বদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বাংলাদেশ ৪ বিলিয়ন মানুষের বাজারের মাঝামাঝি রয়েছে। বৈশ্বিক সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবৃদ্ধির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে আমাদের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশে বৈশ্বিক এফডিআই’র ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রতি ক্রমবর্ধমান আস্থারই প্রতিফলন। ’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ভারতীয় ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে দেশে সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ নীতি বলবৎ থাকার বিষয়টি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে উদার বিনিয়োগের পরিবেশ বিরাজ করছে। যার মধ্যে রয়েছে-বৈদেশিক বিনিয়োগের আইনি সুরক্ষা, উদার রাজস্ব ব্যবস্থা, মেশিনপত্র আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়, আনরেসট্রিকটেড এক্সিট পলিসি, সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ও পুঁজি নিয়ে চলে যাওয়ার সুবিধাসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সংসদের প্রাসঙ্গিক আইন এবং দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তির দ্বারা ও বিদেশি বিনিয়োগকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বিশাল জনসংখ্যা, যাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ বছরের কম, যারা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক মজুরিতে নিযুক্ত হতে প্রস্তুত রয়েছেসহ বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘দ্রুত নগরায়ণের ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্ভাবনার দিকেই ইঙ্গিত করে।’
সন্ত্রাস এবং দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ১৬২ মিলিয়ন জনসংখ্যা সমন্বিত একটি প্রগতিশীল ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। বাণিজ্যের ভারসাম্য যদিও এখন পর্যন্ত ভারতের পক্ষে রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে, বাংলাদেশে ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ভারত এবং বাংলাদেশ এই দেশটির আটতম বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য। ভারতে আমাদের রপ্তানিও গত বছরের প্রথমবারের মতো ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সুতরাং, অগ্রগতি দৃশ্যমান, তবে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সম্পর্ক আরও গভীর করার অনেক সুযোগ রয়েছে।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ভারতের শিল্প ও রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়াল, বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সী, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-ও সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, ভারতের কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির (সিআইআই)-র সভাপতি বিক্রম শ্রীকান্ত কিরলসকার, ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)-র সভাপতি সন্দীপ সোমনি অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অব ইন্ডিয়া (এএসএসওসিএইচএএম)-এর সভাপতি বাল কৃষ্ণ গোয়েঙ্কা।
অনুষ্ঠানে ‘প্রতিশ্রুতিশীল বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি ভিডিও উপস্থাপনা পরিবেশিত হয়।