মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক প্রবল সৃষ্টিশীল সময়। গানে, কবিতায়, ছবি আঁকায়, সিনেমায় মানুষের সৃজনশীলতার শতমুখী স্ফুরণ ঘটেছিল ওই উত্তাল সময়েও। এ রকমই কিছু সাংস্কৃতিক সৃষ্টির কথা—
বিশ্বখ্যাত বিটলস গায়ক এবং বাংলাদেশের বন্ধু জর্জ হ্যারিসন (১৯৪৩-২০০১) তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আই মি মাইন (১৯৮০)-এ একাত্তরের সেই মহান উদ্যোগ ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে বেশ কিছুটা কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, কনসার্টের চেয়ে চলমান যুদ্ধের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বিশেষভাবে লেখা হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত গান ‘বাংলাদেশ’। গায়ক লিওন রাসেল (১৯৪২-২০১৬) হ্যারিসনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন গানের শুরুতেই ঘটনাটা ব্যাখ্যা করার জন্য। জর্জ হ্যারিসন তাঁর বন্ধুর পরামর্শ গ্রহণ করে গানের শুরুটা করেছিলেন একটি ধীরগতির অবতরণিকা দিয়ে:
এল একদিন বন্ধু আমার
চোখভরা তার ধু ধু হাহাকার
বলে গেল, চাই শুধু সহায়তা
দেশ তার আজ ধুঁকে ধুঁকে মরে...
জর্জ হ্যারিসনের এই গানের সেই ‘বন্ধু’ ছিলেন বিশ্বখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর (১৯২০-২০১২)।
আমরা জানি, পণ্ডিত রবিশঙ্করের অনুরোধেই জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর পুরো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সেই কনসার্টই মানবতার জন্য সংগীতের প্রথম সফল বড় আয়োজন।
সেদিনের অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসন হাজার হাজার শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরুতেই বলেছিলেন, ভারতীয় সংগীত আমাদের চেয়ে অনেক গভীর। তারপর তিনি পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান ও সহশিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেন।
সেদিন কনসার্টের শুরুতেই পণ্ডিত রবিশঙ্কর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের গানে শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব “বাংলা ধুন”।’ ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর জন্যই পণ্ডিত রবিশঙ্কর বিশেষভাবে ‘বাংলা ধুন’ নামের এই সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটা দিয়েই ওস্তাদ আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তাদের সঙ্গে তবলায় ওস্তাদ আল্লারাখা আর তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী।
সেদিন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠান দেখতে ও শুনতে প্রায় ৪০-৫০ হাজার দর্শক অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠান থেকে সংগৃহীত ২,৪৩,৪১৮.৫০ ডলার ইউনিসেফের বাংলাদেশের শিশু সাহায্য তহবিলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রবিশঙ্কর ভেবেছিলেন ২৫ থেকে ৫০ হাজার ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। কিন্তু জর্জের ভাবনায় বিটলসের দর্শন, অর্থাৎ যা করব তা বড়ো করে করব। এবং সেটাই হয়েছিল।
২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে তার নিজ বাসভবনে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে আমাদের (বন্ধু ফরহাদ হোসেন) আলাপচারিতায় নানা প্রসঙ্গের মধ্যে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল। তিনি তার বিশেষ সৃষ্টি ‘বাংলা ধুন’-এর বিষয়ে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন। আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, ১৯৭১ সালে মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে তার লেখা ও গাওয়া গান দুটি সম্পর্কেও। রবিশঙ্কর বলেছিলেন, ‘সে সময়ে বড় মনঃকষ্টে ছিলাম। তখন ওই অবস্থাতেই কম্পোজ করেছিলাম গান দুটি। একটি “জয় বাংলা, জয় বাংলা”, অন্যটি “ও ভগবান, খোদাতায়ালা”।’ দুটি গান একটি সিডিতে রেকর্ড করেছিল বিখ্যাত অ্যাপল কোম্পানি। রবিশঙ্কর এই তথ্যও দিয়েছিলেন, যে রেকর্ডটি এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না।
স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকায় আমাদের লন্ডনফেরত বন্ধু ডা. সাইদুর রহমানের সংগ্রহে থাকা সেই গান দুটি আমরা অনেকবার শুনেছিলাম। বন্ধুর সংগ্রহের সিডিটিও পরে হারিয়ে যায়।’
পণ্ডিত রবিশঙ্কর একাত্তরের ১ আগস্টের অনুষ্ঠানের দুদিন পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমার যে অনুভূতি, তার পুরোটাই ব্যক্তিপর্যায়ের। এর কারণ, আমি নিজে একজন বাঙালি।’
সংগীতজগতের এই শ্রেষ্ঠ বাঙালি রবিশঙ্করের পিতা শ্যামশঙ্করের জন্ম বাংলাদেশের নড়াইলের নবগঙ্গা নদীতীরের কালিয়া গ্রামে। সে জন্য রবিশঙ্কর সারা জীবন নিজেকে বাঙালি এবং বাংলাদেশের একজন বলে মনে করতেন।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রবিশঙ্করের বাসভবনে আলাপচারিতায় তাকে বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি পিতার জন্মভূমি কালিয়া গ্রামের কথা বলেছিলেন। গভীর আবেগে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৪০ সালে দাদার (বড় ভাই নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর) সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলাম। নদীপথে যাওয়ার সময় কালিয়ায় নেমে মাটির ছোঁয়া নিয়েছিলাম।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাবার (তার গুরু, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ) বাড়ি হয়ে গিয়েছিলাম।’
আসলে আমরা প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ২০১১ সালের ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকীতে পণ্ডিত রবিশঙ্করকে নিয়ে ঢাকায় দুদিনের অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম। তাকে আমরা সম্মাননা জানাব। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে তার অবদানকে স্মরণ করব।’ আমন্ত্রণপত্রও ছাপা হয়ে গিয়েছিল। ১০ কি ১১ ডিসেম্বর হঠাৎ করে খবর পেলাম, রবিশঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এ সংবাদ পেয়ে গভীরভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তারপরও আশা ছাড়িনি।’
শেষবারের মতো চেষ্টা করার জন্যই ২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রবিশঙ্করের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ সময় ধরে তার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। রবিশঙ্করেরও খুব ইচ্ছে ছিল শেষবারের মতো ঢাকায় আসবেন। অনুষ্ঠান করবেন তার পিতৃভূমিতে। আমরাও আশাবাদ নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু তিনি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায় এসে অনুষ্ঠান করতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল। পরে সেটাই বাস্তব বলে মনে হলো।’ পণ্ডিত রবিশঙ্করকে নিয়ে অনুষ্ঠান আর করা হলো না। সে বছর (২০১২) ১১ ডিসেম্বর তার মহাপ্রয়াণ হলো।
পণ্ডিত রবিশঙ্করকে নিয়ে আমরা একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমাদের সে স্বপ্ন পূরণ হলো না।