দুর্গাপূজায় টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার বাড়ির আঙিনায় হাজারো মানুষের ঢল নামে। জাতি-ধর্ম-ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে দেশি-বিদেশি অতিথির আগমন ঘটে। এ বাড়ির পূজা মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়। পূজাকে উপলক্ষ করে মানুষ পাঁচ দিন ডুবে থাকে অপার আনন্দে। রণদা প্রসাদ সাহার পূর্বপুরুষেরাও বাড়িতে দুর্গাপূজা করতেন। কিন্তু তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দারের সময় এসে আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় দুর্গাপূজা।
শৈশবে মাতৃহারা রণদা প্রসাদ সাহার মাতৃভক্তি ছিল সাধারণের চেয়ে একটু বেশি। মা না থাকায় অনাদরে বড় হওয়ায় রণদা মাত্র ১৬ বছর বয়সে চলে যান কলকাতায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৫ সালে চাকরি পান ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে। কর্মস্থল ছিল ইরাকে। পরে যোগ দেন বেঙ্গলি রেজিমেন্টে। যুদ্ধ শেষে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। দেবী লক্ষ্মী তাঁর ভান্ডার পূর্ণ করে দেন। ব্যবসা-বাণিজ্য করে যতই বড় হোক, তাঁর মন পড়ে ছিল মায়ের স্মৃতিবিজড়িত মির্জাপুর গ্রামে। ত্রিশের দশকের শুরুতে আবার নিজের বাড়ির মন্দিরে জমজমাট আয়োজনে দুর্গাপূজা শুরু করেন। শুধু পূজা নয়, পূজাকে কেন্দ্র করে যাত্রাপালা, নাটক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হতো। দরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরণ করতেন বস্ত্র।
চল্লিশের দশকের শুরুতে রণদা প্রসাদ সাহা নিজের মায়ের নামে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। ট্রাস্টেই তিনি ন্যস্ত করেন তাঁর সব ব্যবসা, সম্পদ। মির্জাপুরে নিজ গ্রামে লৌহজং নদীর তীরে মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল এবং নারী শিক্ষার জন্য প্রপিতামহীর নামে ভারতেশ্বরী হোমস প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে কলকাতা, নারায়ণগঞ্জ যেখানে যে অবস্থায়ই ব্যস্ত থাকতেন রণদা প্রসাদ সাহা, পূজার সময় ঠিক চলে আসতেন মির্জাপুরের বাড়িতে। নিজের তত্ত্বাবধানে পূজার সব আয়োজন করতেন। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি এ পূজার নাম ছড়িয়ে পড়ে চারপাশের এলাকায়। দূরদূরান্ত থেকে নৌকা নিয়ে মানুষ আসতেন পূজা দেখতে। তাঁরা লৌহজং নদীতে নৌকায় থেকে চার-পাঁচ দিন উৎসবে অংশ নিতেন।
মির্জাপুর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি অতুল পোদ্দার সে সময়কার স্মৃতিচারণা করে বলেন, পূজার পাঁচ দিন শত শত মানুষের খাবারের আয়োজন হতো। দূরদূরান্তের মানুষ এখানে থেকে পূজার উৎসব দেখত। রণদা প্রসাদ সাহা নিজেও অভিনয় করতেন যাত্রাপালায়। পূজার আগে এলাকার সব মানুষের মাঝে বস্ত্র বিতরণ করতেন। ভারতেশ্বরী হোমস চালু হওয়ার পর এ পূজার আয়োজনের সবকিছুই করে থাকেন এখানকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। পঞ্চাশের দশকের ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্রী শান্তি সাহা বলেন, পূজার পাঁচ দিন নানা অনুষ্ঠানে জমজমাট থাকত রণদা প্রসাদ সাহার পূজামণ্ডপ। এ বাড়ির পূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর সব আয়োজন করে থাকেন নারীরা। টাঙ্গাইলের আইনজীবী নীহার সরকার বলেন, সেই ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে রণদা প্রসাদ সাহার বাড়িতে পূজা দেখতে গেছি। আজ তিনি নেই, কিন্তু সেই আয়োজন আছে। আমি এখনো আমার সন্তানদের নিয়ে সেখানে পূজা দেখতে যাই। এ বাড়ির পূজার আয়োজনটাও অন্য আর দশটি পূজামণ্ডপের মতো নয়। এখানে পঞ্চমীর দিনে সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে পূজা শুরু হয়। প্রতিদিন নাচ, গান, আরতিসহ নানা আয়োজন থাকে। বিজয়া দশমীতে নৌকার করে লৌহজং নদী ঘুরে দেবী দুর্গাকে বিসর্জন করা হয়।
১৯৭১ সালের ৭ মে রণদা প্রসাদ সাহা ও তাঁর ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁরা আর ফিরে আসেননি। অনেকেই সে সময় ভেবেছিলেন বাবা-ছেলের অন্তর্ধানের মধ্যদিয়ে জাঁকজমক পূজার আয়োজনও হারিয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। ’৭২ সালে তাঁর বড় মেয়ে জয়া পতি কুমুদিনী কল্যাণ ট্রাস্টের দায়িত্ব নেন। তিনি তাঁর বাবার মতোই আয়োজন অব্যাহত রাখেন। আর রণদা প্রসাদ সাহার নাতি রাজিব প্রসাদ সাহা এখন কুমুদিনী কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। তিনি বর্তমানে পূজার আয়োজনে এনেছেন আরও বর্ণাঢ্যতা। তাই আজও এখানে পূজা দেখতে আসেন রাজনীতিক, সরকারি পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কূটনীতিক, দেশবরেণ্য ব্যক্তি, শিল্পী, সাহিত্যিকসহ সব শ্রেণির মানুষ। রণদা প্রসাদ সাহার পুত্রবধূ শ্রীমতী সাহা রণদা প্রসাদ সাহা স্মারকগ্রন্থে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘পূজার সময় দেখেছি সব শ্রেণির হাজার হাজার মানুষের সম্মিলন। পাঁচ দিন ধরে চলত খাওয়াদাওয়া, সেই সঙ্গে যাত্রাপালা বিনোদন। অপার আনন্দ, পূজা উপলক্ষমাত্র। বাবা (রণদা প্রসাদ) বলতেন, মানুষ ও মানুষে এই যে মহামিলন—এই তো পূজার আনন্দ।’
কামনাশীষ শেখর: প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি