সেনেগাল। পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ। সেই দেশের মেয়ে ম্যানি ভিয়েরা এনডিয়া। হাজার হাজার মাইল দূরের সেই দেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছেন চট্টগ্রামে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে। সে জন্য তাঁকে সৃজনশীল হতে হবে। হতে হবে উদ্যমী। তাঁকে অর্জন করতে হবে নেতৃত্বের ক্ষমতা। সেই প্রত্যয়ে তিনি বেড়ে উঠছেন, নিজেকে গড়ে তুলছেন। তাঁকে সাহায্য করছেন পৃথিবীর সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা কীর্তিমান শিক্ষক বন্ধু। ম্যানি ভিয়েরা একা নন। তাঁর সঙ্গে আছেন পৃথিবীর ১৭টি দেশের ৮০০ শিক্ষার্থী। তাঁরা সবাই এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) শিক্ষার্থী। এটি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়; নানা সংস্কৃতির, নানা ভাষার, নানা মানুষের এক অসাধারণ মেলবন্ধন। বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক স্বপ্নের পৃথিবীর এক প্রতীকী রূপ যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের যোগসাধন যেন এই গৌরবকে আরও এক উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেল।
চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির পাশে মোহাম্মদ আলী রোডে অস্থায়ী ক্যাম্পাসটি বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, এর ভেতরে একটা পৃথিবী সরব ও সদা সরগম। এখানে চলছে নিরন্তর জ্ঞানচর্চা। ওখানে রয়েছে আফগানিস্তান, ভুটান, কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, সেনেগাল, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া, ভিয়েতনাম, ইয়েমেন এবং বাংলাদেশের ৮০০ শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থী ওখানে থাকেন, পড়ালেখা করেন এবং সৃজনশীল নানা কাজের এক বিশাল কর্মযজ্ঞে নিজেদের সর্বক্ষণ নিয়োজিত রেখেছেন।
শিক্ষা মানে শুধু সার্টিফিকেট অর্জন নয়, শিক্ষা মানে জ্ঞানচর্চা, পৃথিবীর উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত করা এবং সমাজের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফল উইমেন সেই লক্ষ্য নিয়েই সারা পৃথিবীর নানা সংস্কৃতির, নানা বর্ণের, নানা জাতির মানুষের এক বিশাল বন্ধন তৈরি করেছে এই চট্টগ্রামে। তৈরি করেছে এই অসাধারণ বৈশ্বিক পরিমণ্ডল। এই বিশ্ববিদ্যালয় নারীদের স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষাদান করছে। তাদের লক্ষ্য সেবা ও বাণিজ্য খাতে নেতৃস্থানীয় দক্ষ ও সৃজনশীল নারী পেশাজীবী তৈরি করা। পাশাপাশি আন্তসাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে এশিয়া এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এর উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৮ সালে এর যাত্রা শুরু হয়। সে বছর বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ১৩০ জন শিক্ষার্থী ছিল।
এখন সেটা বেড়ে দাঁড়াল ৮০০–তে। এই ৮০০ শিক্ষার্থী বায়োইনফরমেটিকস, ইকোনমিকস, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, পলিটিকস ফিলোসফি অ্যান্ড ইকোনমিকস, পাবলিক হেলথ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। আর তাঁদের সাহায্য করছেন ৭১ জন শিক্ষক। এই শিক্ষকেরা এই শিক্ষাকেন্দ্রের প্রাণ। তাঁদের মধ্যে অনেকেই হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে পিএইচডি করা। তাঁরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষক, প্রশিক্ষক, বন্ধু এবং পরামর্শক।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে উপাচার্যের দপ্তরের নির্বাহী কর্মকর্তা তপু চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ভর্তির সব নিয়মকানুন দেওয়া আছে। অনলাইনে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আবেদন আসে। সেসব আবেদন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে বাছাই করে। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জিত ফলাফল, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং প্রার্থীর সার্বিক অবস্থা যাচাই করা হয়। পাশাপাশি তাঁর আগ্রহ, শিক্ষানুরাগ, সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম, নিজ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হয়। প্রাথমিক তালিকায় থাকা আবেদনকারীদের স্থানীয়ভাবে পরিচালিত লিখিত ও মৌখিক সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। ওই পরীক্ষায় প্রার্থীর ইংরেজি ভাষা ও যোগাযোগের দক্ষতা, গণিত ও জটিল সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা যাচাই করা হয়।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ক্রমে বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে বলে মনে করেন এখানকার কর্মকর্তা। এটি হবে বাংলাদেশ কিংবা এশিয়ার গর্ব করার মতো একটি প্রতিষ্ঠান। আর এই গর্বের প্রতিষ্ঠানটি যাঁর স্বপ্নে গড়ে উঠেছে, তিনি হলেন কীর্তিমান পুরুষ বিশ্বব্যাংক, রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং ইউনিসেফের সাবেক কর্মকর্তা কামাল আহমেদ। তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন সাপোর্ট ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সারা পৃথিবী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছেন। ব্র্যাক ইউএসএর বোর্ড অব ডিরেক্টরের একসময়কার এই সদস্যই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। জাতিসংঘের গোল্ড মেডেলসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত কামাল আহমেদই এশিয়ায় নারী শিক্ষা ও নেতৃত্বের উন্নয়নের লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের বিশাল কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রফেসর নির্মলা রাও। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের মেয়েদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য তৈরি করি। যাতে তারা নিজেদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এ জন্য আমরা জোর দিই জটিল চিন্তাপদ্ধতি আয়ত্ত ও সমস্যানির্ভর শিক্ষার ওপর। পাশাপাশি সহানুভূতি, আত্মমর্যাদাবোধ, সাহস এবং আশাবাদের মতো মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের মাঝে। যাতে পরবর্তী জীবনে এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে তারা এগিয়ে যেতে পারে।’
এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটির কলেবর দিন দিন বড় হচ্ছে। ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে এর শিক্ষাপদ্ধতি। আর তাই প্রতিবছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। তারা যুক্ত হতে চায় এই বৈশ্বিক মেলবন্ধনে। আর তাই এদের জন্য দরকার আরও বড় পরিসর। আরও বড় ক্যাম্পাস। এ জন্য মোহাম্মদ আলী সড়কের ছোট ক্যাম্পাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বড় পরিসরে যেতে চায়। উপাচার্য বলেন, বাংলাদেশ সরকার তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য এই চট্টগ্রামেই ১৪০ একর ভূমি বরাদ্দ করেছে। স্থায়ী ক্যাম্পাসের কাজ শুরু হবে শিগগিরই।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে আসনসংখ্যা
• বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামে (ইউএসটিসি) ৩০ বিভাগে আসন ১ হাজার ৩৫টি।
• আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে (আইআইইউসি) ১১ বিভাগে আসন ৫ হাজার ২৫টি।
• বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটিতে ৫ বিভাগে আসন ৯৪০টি।
• প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বিভাগে আসন ৩ হাজার ৯০০টি।
• সাদার্ন ইউনিভার্সিটিতে ৯ বিভাগে আসন ১ হাজার ৬০৬টি।
• ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটিতে ৭ বিভাগে আসন ১ হাজার ৮০০টি।
• পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ১০ বিভাগে আসন ৩ হাজার ৪২০টি।
• চিটাগং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে ৪ বিভাগে আসন ৯৭৬টি।
• ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি চট্টগ্রামে ৫ বিভাগে আসন ২৭০টি।
সূত্র: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন