যেভাবে বদলে গেল রাঙ্গাবালী

পটুয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালী। এই জনপদের চারদিকেই জলরাশি। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। উত্তরে আগুনমুখা, পূর্বে বুড়াগৌরাঙ্গ ও পশ্চিমে রাবনাবাদ নদ।

বিদ্যুৎ পৌঁছানোর পর বদলে যাচ্ছে দুর্গম এই উপজেলার চিত্র। যে রাঙ্গাবালী বাজারে ছয় মাস আগেও কোনো ইলেকট্রনিকস পণ্যের শোরুম ছিল না, সেখানে এখন গোটা চারেক শোরুম। বিক্রিবাট্টাও ভালো। গড়ে উঠেছে অনলাইনে নানা সেবা দেওয়ার দোকান। উপজেলায় দুটি ধানের চাতালও হয়েছে। মৎস্যজীবীদের জন্য বসানো হয়েছে বরফকল।

গত শনিবার উপজেলা সদর ও বিভিন্ন চরের মানুষের সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয় লোকজন জানান, এসব পরিবর্তন ঘটেছে গত কয়েক মাসে, উপজেলায় বিদ্যুৎ পৌঁছানোর পর। গত সেপ্টেম্বরে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয় নদীর তলদেশ দিয়ে (সাবমেরিন কেব্‌লের মাধ্যমে)।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সোমবার রাঙ্গাবালীর পাশের উপজেলা কলাপাড়ায় পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন করবেন। তিনি দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় চলে আসার ঘোষণাও দেবেন। এই অর্জনের পথে সর্বশেষ বাধা ছিল রাঙ্গাবালী উপজেলা, পটুয়াখালী শহর থেকে যার দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে।

জীবন যেভাবে বদলাচ্ছে

উপজেলায় যেদিন বিদ্যুৎ চালু হলো, সেদিনই রাঙ্গাবালী বাজারে ইলেকট্রনিকস পণ্যের শোরুম উদ্বোধন করেন বনি আমিন। তিনি জানান, আগে এই বাজারেই তাঁর সাউন্ড সিস্টেমের দোকান ছিল।

এই মাস পাঁচেকের মধ্যে তিন শর মতো ফ্রিজ বিক্রি করেছেন বনি আমিন। টিভি ও ফ্যান বিক্রি করেছেন আরও বেশি। বনি আমিন বলেন, কয়েক দিন পরই এলাকার চাষিরা তরমুজ বিক্রি শুরু করবেন। গরমও পড়েছে। ফলে আরও বেশি পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।

বনি আমিনের শোরুমে রাইস কুকার কিনতে আসেন স্থানীয় হাসনাইন আহমেদ। তিনি জানান, তাঁর বাড়ির নির্মাণকাজ চলছে। শ্রমিকদের খাওয়াতে হবে। রাইস কুকার হলে সহজে রান্না করা যাবে। বিদ্যুৎ থাকায় এ সুযোগটা নিচ্ছেন।

পিরোজপুরের মো. আবদুল্লাহ কক্সবাজারে চালকল–চাতালে কাজ করেছেন। করোনা মহামারিতে তিনি কাজ হারিয়েছেন। দেড় বছর বাড়িতে ছিলেন। এর মধ্যে মাস পাঁচেক আগে জানতে পারেন রাঙ্গাবালীর বাহেরচরে একটি রাইস মিল ও চাতাল হয়েছে। অভিজ্ঞতার কারণে এখানে কাজ জুটে যায়। তিনি জানান, বিদ্যুৎ আসার পরই এই চালকল চালু হয়েছে। তিনি ১৫ হাজার টাকা বেতনে শ্রমিকদের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। থাকা-খাওয়া বিনা মূল্যে। এই চাতালে ৭ জন নারী ও ১০ জন পুরুষ কাজ করেন বলে তিনি জানান।

চাতালের মালিক সঞ্জীব কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আগে চালের ব্যবসা করতেন। বিদ্যুৎ আসায় চাতাল চালু করেছেন। দুই দিনে ৭০ মণ ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে চাল করা হয়।

রাঙ্গাবালী বাজারে ফটোকপি, লেমিনেটিংসহ অনলাইনে নানা কাজ করার দোকান দিয়েছেন মাইনুল ইসলাম। তিনি জানান, স্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার পাশাপাশি এই দোকান চালান তিনি। বিদ্যুৎ আসার আগেও দোকানটি ছিল। তবে তখন জেনারেটর ও সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে অল্পস্বল্প কাজ করতেন। এখন সব কাজই বিদ্যুতের সাহায্যে সহজে করতে পারছেন।

মাইনুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ আসার আগে রাঙ্গাবালীতে গোটা দশেক ফটোকপির দোকান ছিল। এখন অনলাইনে নানা সেবা দেওয়ার ২৫টি দোকান খোলা হয়েছে।

এ ছাড়া রাঙ্গাবালীর মানুষের জীবিকার আরেকটি বড় উৎস মৎস্য আহরণ। কিন্তু অন্য উপজেলা থেকে বরফ এনে মাছ সংরক্ষণ করতে হতো। বিদ্যুৎ আসার পর বেশ কিছু বরফকল হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা সদরের পাশে একটি মুড়ি ভাজার কারখানা চালু হয়েছে।

অবশ্য বিদ্যুৎ এলেও লোডশেডিং বেশি হয় বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান। উপজেলার আমলিবাড়িয়ার ইদ্রিস সরদার বলেন, দিনের বড় একটা সময় বিদ্যুৎ থাকে না। এ জন্য বাড়িতে আগে থেকে থাকা সৌরবিদ্যুতের প্যানেলও রেখেছেন।

রাঙ্গাবালীতে যেভাবে বিদ্যুৎ এল

রাঙ্গাবালী উপজেলা হয় ২০১২ সালে। উপজেলায় বিদ্যুতায়নের প্রকল্প শুরু হয় ২০২০ সালে। ১৪ মাসের মধ্যে এই কাজ শেষ হয়। এখন উপজেলা সদর, চর মন্তাজ, চলিতাবুনিয়া, চর কাজল, চর বিশ্বাস, চর কাশেম, ছোট বাইশদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার ২৫ হাজার ৩৩৮ জন বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। মোট ৬টি ইউনিয়নের দুর্গম ১০৪টি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। এতে ব্যয় হয়েছে ২৬০ কোটি টাকা।

পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ জানায়, জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে রাঙ্গাবালীর ছোট বাইশদিয়া ইউনিয়নের গহিনখালীতে ১০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র বসানো হয়েছে। ভোলার মুজিবনগর উপকেন্দ্র থেকে আমগাছিয়া বাজার হয়ে বুড়াগৌরাঙ্গ নদের দুই কিলোমিটার তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেব্‌ল পৌঁছেছে গহিনখালী উপকেন্দ্রে। এর আগে আরও দুটি নদীর তলদেশ দিয়ে তার টানতে হয়। পুরো উপজেলায় বসানো হয়েছে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটারের বেশি সঞ্চালন লাইন।

পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক শাহ্ মো. রাজ্জাকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাবমেরিন কেব্‌লের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মাধ্যমে দুর্গম এই উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা গেছে। এখন প্রতিদিনই উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে।