ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিউমোনিয়া, কাশি, ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, হাঁপানি, যকৃতের দুরোরোগ্য ব্যাধিসহ নানা রোগ হতে পারে।
১২ ও ১৩ বছর বয়সী মামাতো–ফুপাতো দুই ভাই তাদের পরিবারের সঙ্গে থাকে রাজধানীর শ্রমঘন এলাকা কামরাঙ্গীরচরে। ২০২০ সালে করোনা শুরুর আগে দুজন স্থানীয় একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। করোনায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পর শিশু দুটির বাবা–মায়েরা বাড়ির কাছের এক প্লাস্টিক কারখানার মালিককে ধরে কাজে ঢুকিয়ে দেন।
৮ জুন বুধবার দুপুর ১২টার দিকে কামরাঙ্গীরচরের নূরবাগে ওই প্লাস্টিক কারখানায় গিয়ে দেখা হয় দুই ভাইয়ের সঙ্গে। মেঝেতে বসে ভারী যন্ত্রের হাতল সজোরে চেপে ফ্যানের ক্লিপ বানাচ্ছিল বিরতিহীনভাবে। প্রথম আলোকে তারা জানাল, প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে কাজে যোগ দিয়েছে। স্কুল খুলে গেলেও এ বছর আর ফিরে যায়নি। তারা জানায়, সকাল ৯টা থেকে রাত ৮–৯টা পর্যন্ত কাজ করে। তবে কারখানার এক প্রাপ্তবয়স্ক কর্মীর দাবি, শিশু দুটি এত সময় কাজ করে না। ওই কারখানায় আরেকটি কিশোরকে কাজ করতে দেখা গেছে।
নূরবাগে পাঁচটি কারখানা ও কালারবাড়ি নামের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর বাসস্থান ঘুরে দেখা যায়, সেখানে শিশুশ্রম ‘স্বাভাবিক’ একটি বিষয়। অ্যালুমিনিয়ামের দুটি কারখানায় ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী চার কিশোরকে কাজ করতে দেখা গেছে। কালারবাড়িতে ২৫টি পরিবার বসবাস করে। এর মধ্যে একটি পরিবারের ৭ বছর বয়সী এক ছেলে শিশুকে মায়ের সঙ্গে কাজে যুক্ত থাকতে দেখা গেছে।
আজ ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করি, শিশুশ্রম বন্ধ করি।’
শিশুদের স্কুলে পাঠানোর মধ্য দিয়ে শিশুশ্রম রোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও মালিকপক্ষকে সচেতন করতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে সরকারকে।রাফেজা শাহীন, সমন্বয়কারী, শিশু সুরক্ষা বিভাগ, এমজেএফ
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে, ‘শিশু’ অর্থ ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন ব্যক্তি এবং ‘কিশোর’ অর্থ ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেছে এবং ১৮ বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন ব্যক্তি। জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ অনুসারে, শিশুদের আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে দেওয়া যাবে না। কিশোরদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসকের কাছ থেকে শিশু–কিশোরদের সক্ষমতা সনদ নিয়ে শর্ত সাপেক্ষে হালকা কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে।
সবশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩ অনুসারে, দেশে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৭ লাখ শিশু শ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার উপমহাপরিদর্শক এ কে এম সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য রয়েছে। সে লক্ষ্য নিয়ে সরকার অভিভাবক ও কারখানার মালিকদের শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সচেতন করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। ৩৮টি খাতের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৮টিকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
কামরাঙ্গীরচরে ওই দুই শিশু ভাইয়ের মধ্যে এক শিশুর বাবার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। পেশায় তিনি বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি। তিনি বলেন, করোনায় তাঁর কাজে ভাটা পড়ে। তখন থেকে রিকশা চালাচ্ছেন। অনটনের মধ্যে পড়ে তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলেকে (১৩ বছর) দুই বছর আগে প্লাস্টিক কারখানার মালিককে অনুরোধ করে কাজে দিয়েছেন। সপ্তাহে ছেলের আয় ১ হাজার ৪০০ টাকা। ছেলেকে আবার স্কুলে দেবেন কি না—জানতে চাইলে বলেন, ‘পড়ানোর ইচ্ছে আছে। পড়ার জন্য সময় দিতে বলব মালিককে।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কমিউনিটি পার্টিসিপেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিডি) ২০১৯ সালে কামরাঙ্গীরচর এলাকার নূরবাগ, নিজামবাগ ও আশ্রাফাবাদ স্থানে শিশুশ্রমের ওপর এক সমীক্ষা করে। এতে বলা হয়, ওই তিনটি স্থানে আনুমানিক ৪৩৩ কারখানায় ১২ শতাধিক শিশু-কিশোর কাজ করে।
নূরবাগের একটি অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় বেলা ১১টার সময় পলিশের কাজ করছিল তিন কিশোর। জামাকাপড়, চুল ও মুখ অ্যালুমিনিয়ামের গুঁড়া লেগে ধূসর হয়ে গেছে। একজন বলল, বিকেল হতে হতে তাদের আর চেনা যায় না। তিন কিশোর প্রথম আলোকে জানায়, পরিবারকে সহায়তা করার জন্য তারা কাজে যোগ দিয়েছে। সপ্তাহে ২ হাজার ২০০ টাকা পায়। সবচেয়ে ছোট কিশোর (১৫) জানায়, বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায়। সাত মাস আগে টাঙ্গাইলের একটি কারখানায় কাজ নেয়। এক মাস আগে কামরাঙ্গীরচরের কারখানায় এসেছে।
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় করোনায় স্কুল বন্ধ হলে আর স্কুলে ফিরে যায়নি। বাবা কৃষিকাজ করেন। অপর দুই কিশোরের একজনের বাড়ি নদীভাঙনের শিকার। সে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। ছয় ভাই–বোনের মধ্যে তৃতীয় এক কিশোর বলল, ‘বাবা বলছে, ছোট থেকে কাজে না ঢুকলে কাজ শিখতে পারব না।’ সে কখনো স্কুলে যায়নি।
আরেক অ্যালুমিনিয়াম কারখানার এক কিশোর জানাল, সে–ও কখনো স্কুলে যায়নি।
৩৮টি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে ২০১৩ সালে গেজেট প্রকাশ করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ বছর নতুন করে আরও ৫টি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে (এখনো গেজেট হয়নি)। এই ৪৩টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তালিকায় অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক কারখানা যথাক্রমে ১ ও ৯ নম্বরে। এ ধরনের কারখানায় কাজ করলে শিশুদের নিউমোনিয়া, কাশি, আঙুলে দাঁদ, দুর্ঘটনাজনিত দৈহিক ক্ষত, ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, হাঁপানি, যকৃতের দুরোরোগ্য ব্যাধি, মূত্রাশয় ক্যানসারের মতো রোগ হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
কামরাঙ্গীরচরের ‘মেহেদী মেটাল’–এর মালিক মো. শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কারখানায় কিশোর থাকলেও কোনো শিশু নেই। অভিভাবকেরা এসে অভাবের কথা বলেন। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি দু–তিনজন কিশোরকে হালকা কাজে নিয়োগ দেন।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ‘শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের সুরক্ষা কর্মসূচি (পিডব্লিউসি)’– এর আওতায় ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা (কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জ), কুমিল্লা, বরিশাল, যশোর ও খুলনায় একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে অংশ নেয় শ্রমে নিয়োজিত ৩৩ হাজার শিশু। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাম থেকে শহরে এসে কাজে নতুন যুক্ত হয়েছে ৩ হাজার ২৪০ শিশু, কাজ ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, এমন আড়াই হাজার শিশু করোনাকালে পরিবারকে সহায়তা করতে আবার কাজে ফিরে গেছে। আগের চেয়ে কম পারিশ্রমিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে ২ হাজার ৪০০ শিশু। নতুন করে ৭ হাজার ৮০০ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে।
কামরাঙ্গীরচরে বেড়িবাঁধসংলগ্ন কালারবাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, উঠানে বসে ১৩ ও ১৫ বছর বয়সী দুটি মেয়ে ক্লিপ বানানোর কাজ করছে। পাশের একটি ঘরের বারান্দায় বসে থাকা এক নারী প্রথম আলোকে বললেন, এখানে সব ঘরেই ছোট ছেলেমেয়েরা কাজ করে। তিনি একটি কারখানায় প্লাস্টিকের বোতলের টিউব বানান। তাঁর কষ্ট দেখে ৭ বছর বয়সী ছেলে তাঁকে সাহায্য করা শুরু করে।
কারখানামালিকের এ দৃশ্য দেখে মায়া লেগে যায়। তিনি ছেলেকে সপ্তাহে ৭০০ টাকা মজুরিতে কাজ দেন। এত ছোট ছেলেকে কাজে দিয়েছেন কেন—জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, স্বামী বেকার। মেয়েকে ১৪–১৫ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে কখনো স্কুলে যায়নি। তবে তাঁর খুব ইচ্ছে, ছেলে পড়াশোনা করুক।
এমজেএফ–এর শিশু সুরক্ষা বিভাগের সমন্বয়কারী রাফেজা শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের স্কুলে পাঠানোর মধ্য দিয়ে শিশুশ্রম রোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও মালিকপক্ষকে সচেতন করতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে সরকারকে। কঠোর পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে অভিভাবকেরা কাজে নয়, সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হন। যে শিশুরা শ্রমে নিয়োজিত আছে, তাদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে, যেন তারা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার না হয়।