মো. বখতিয়ার হামিদ
মো. বখতিয়ার হামিদ

যেখানে পাখির কলরবে ঘুম ভাঙে

যেখানে পাখির কলরবে ভোর হয়, ঘুম ভাঙে গ্রামবাসীর, গিরিগিটি, কাঠবিড়ালি, গুইসাপ, নেউল, খরগোশ, শিয়াল ও কুকুরের সহাবস্থানও রয়েছে সেখানে। বন্য প্রাণী ও পাখি শিকার এবং বেওয়ারিশ কুকুরনিধন নিষিদ্ধ হওয়ায় বন্য প্রাণী ও পাখিরা বন-বনানী থেকে লোকালয়ে অবাধে নির্ভয়ে চলাচল করে। সেই গ্রামটির নাম বেলগাছি। স্কুলশিক্ষক বখতিয়ার হামিদের প্রচেষ্টায় যা এখন পাখির গ্রাম হিসেবে পরিচিত।

গাইদঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বখতিয়ার হামিদ সমমনা ও তরুণদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘কেয়ার ফর আনক্লেমইড বিস্ট-কাব’। অসুস্থ বন্য প্রাণী ও পাখিদের জন্য তৈরি করেছেন হাসপাতাল।

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বেলগাছি গ্রামজুড়েই রয়েছে ‘পাখি শিকার নিষিদ্ধ’, ‘এসো পাখির বন্ধু হই’ স্লোগানসংবলিত সাইনবোর্ড। রাস্তার দুই ধারে, পুকুরপাড়ে, ফসলি জমিতে নানান প্রজাতির গাছে গাছে ‘মাটির কলসির ফ্ল্যাট’। যেখানে রয়েছে নানা প্রজাতির রংবেরঙের পাখির বসবাস।

কয়েক বছর ধরে শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের মিলনমেলা বসে বেলগাছি গ্রামে। মেটে তিতির, জার্ডন লিফবার্ড বা পাতা বুলবুলি, কমন ব্যবলার, হলুদ চোখ ছাতারে ও জলময়ূর পাখি অতিথি হয়ে এলেও গ্রামটির প্রকৃতি ও প্রকৃতির মতো সহজ-সুন্দর মানুষের ভালোবাসা ছেড়ে আর ফিরে যেতে পারেনি। গড়েছে স্থায়ী নিবাস, করেছে বংশবিস্তারও।

শিকারিদের অত্যাচারে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া পাখি ও বনের প্রাণীদের গ্রামটিতে ফিরিয়ে আনতে বখতিয়ার ২০১১ সালে ৩৫ জন সমমনা তরুণদের সংগঠিত করেন। সে সময়ে টিউশনির উপার্জন থেকে সঞ্চিত কয়েক হাজার টাকা ও পাখাপাখালির প্রতি ভালোবাসাকে পুঁজি করে গ্রামের রাস্তার দুই ধার ও কবরস্থানের গাছগুলোতে অন্তত ১ হাজার কলসি বেঁধে দেন। এরপর কলসির সংখ্যা বাড়তেই থাকে। দিনে দিনে কলসিগুলো পাখিতে ভরে যায়। এরপর পাখিদের খাবার জোগাতে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের খেতে বাঁশের মাচা ও পুরোনো ডাল পুঁতে পাখিদের বসার ব্যবস্থা করেন। পাখিরা ডালে বসে ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলায় জমিতে কীটনাশকের ব্যবহারও কমতে থাকে।

২০১২ সাল থেকে পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করে গ্রামটিতে। শীতকালে পরিযায়ী পাখি আসে দল বেঁধে। আবার শীত শেষে নির্বিঘ্নে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। শালিক, ঘুঘু, প্যাঁচা, শ্যামা, শামুকখোল, বক, চন্দনা টিয়া, হীরামন টিয়ার আনাগোনা রয়েছে। বখতিয়ার বলেন, ‘অনুকূল পরিবেশ পেয়ে প্রায় ২০ বছর পর বাবুই পাখি ফিরে এসেছে আমাদের গ্রামে। তাল ও নারকেলগাছে তারা বাসা বেঁধেছে। ভাবতে ভালোই লাগে।’

সহযোদ্ধা আরিফুজ্জামান বখতিয়ার জানালেন, পাখিরাও পরিবেশ ও প্রকৃতিতে অবদান রেখে চলেছে। গ্রামের মাঠে মাঠে ইদানীং নিমসহ বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি, ফল ও ফুলের গাছের দেখা মেলে। যেগুলো কেউ রোপণ করেনি। পাখিরা ফল খেয়ে বীজ ফেলায় গাছগুলো জন্মেছে।

শুধুই কি পাখি? বন্য প্রাণী ও বেওয়ারিশ কুকুরের জন্যও অভয়াশ্রম এই বেলগাছি। গ্রামের মাঠে গেলেই এখন দেখা মেলে দেশি বুনো খরগোশ, বনবিড়াল, বাগডাশ, মেছো বাঘ ও শিয়ালের। যে প্রাণীগুলো অনেক জেলা থেকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যাদের বড় ভূমিকা রয়েছে।

মাটির কলসে পাখির বাসা—আইডিয়াটি বিপুলের মাথা থেকে এলেও তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ও ইউএনওর বাংলো, ডিসি ইকোপার্ক এবং সর্বশেষ চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকাকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হিসেবে কাজ শুরু করেছেন বখতিয়ার ও তাঁর বন্ধুরা। সর্বশেষ ট্রাফিক সার্জেন্ট জেলা পুলিশের ৩৯টি স্থাপনায় মাটির কলসে পাখির বাসা তৈরির কাজ শুরু করেছেন।