যেখানে আছে বিজয়ের গল্প

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘরে তাঁর ছেলে সাইফ ইমাম জামি l ছবি: প্রথম আলো
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘরে তাঁর ছেলে সাইফ ইমাম জামি l ছবি: প্রথম আলো

অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িটির দোতলায় যেন থমকে দাঁড়িয়েছে ইতিহাস। এলিফেন্ট রোডের ছোট্ট এক গলিতে বাড়িটা, অথচ সেখানে থাকা জাদুঘরে ঢুকলেই মনে হয়, এখানেই তো স্থির হয়ে আছে বিজয়ের গল্প। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে যে বিশাল গণ-আন্দোলন গড়ে উঠল গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, তা যেন জীবন্ত হয়ে স্থান করে নিয়েছে এই বাড়িটার দোতলায়।
এতক্ষণে অনেকেই বুঝে গেছেন, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি সাজানো ‘শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর’-এর কথাই বলা হচ্ছে। যাঁরা শহীদজননীকে সামনাসামনি দেখেননি, তাঁর সম্পর্কে জানেন কম, তাঁদের বলি: অকুতোভয় এই নারী শত বাধা পেরিয়েও গণ-আদালতকে জনমানুষের মনের গভীরে প্রথিত করে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যেই যখন কোনো এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে ষড়যন্ত্রের চোরা স্রোতে উল্টো পথে চলা শুরু করল ইতিহাস, যখন একাত্তরের ঘাতকেরা পেল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, মন্ত্রিত্ব; তখন অনেকেই মিনি পাকিস্তানে পরিণত এই দেশে যুদ্ধাপরাধী কুলাঙ্গারদের বিচারের ব্যাপারে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। সেই বিশ্বাসের মশালে আগুন জ্বালিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে শহীদজননী জাহানারা ইমাম ছিলেন উজ্জ্বলতম।
শুধু প্রতি শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এই জাদুঘর খোলা থাকে দর্শনার্থীদের জন্য। কনিকা, ৩৫৫ শহীদজননী জাহানারা ইমাম সরণি (পুরোনো এলিফেন্ট রোড) জাদুঘরের ঠিকানা। ঢুকেই বাঁ দিকে চোখে পড়বে এক আলমারি, যাতে ডিনার সেট, চায়ের সরঞ্জাম সাজানো। যেন এসব দিয়ে শহীদজননী অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। এরপর তিন প্রজন্মের তিনজনের ছবি। মোহাম্মদ আলী (১৮৮২-১৯৭৫), শরীফুল আলম ইমাম আহমেদ (১৯২৭-১৯৭১) ও শাফি ইমাম (১৯৫১-)। অর্থাৎ দাদা, বাবা ও নাতি। তাঁদের জন্ম ও মৃত্যু সালের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, দাদার মৃত্যু হয়েছে সবার পরে, স্বাধীন দেশে। বাবার মৃত্যু হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়টিতে। আর শাফি ইমাম রুমীর শুধু জন্মের বছরটাই লেখা রয়েছে। কারণ, একাত্তরে রুমীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, সেটা জানা যায়নি কখনো। শহীদজননী নিজেও বহুদিন রুমী নেই এ কথা বিশ্বাস করতেন না। একাত্তরের দিনগুলি লেখার মাধ্যমে মূলত তিনি মেনে নিয়েছিলেন রুমীর মৃত্যু।

জাদুঘরটি স্মৃতির আকরগ্রন্থ। কেউ যদি গণ-আদালতের ব্যাপারে জানতে চান, তাহলে ছবি, লেখা, পোস্টার ও বইতে পেয়ে যাবেন সেই সময়টিকে।


জাদুঘরটি স্মৃতির আকরগ্রন্থ। কেউ যদি গণ-আদালতের ব্যাপারে জানতে চান, তাহলে ছবি, লেখা, পোস্টার ও বইতে পেয়ে যাবেন সেই সময়টিকে। গোলাম আযম নামক এক বাংলাদেশবিরোধীর বিরুদ্ধে যখন জেগে উঠছে দেশ, সরকারি বাধা উপেক্ষা করে যখন গণ-আদালতের সঙ্গে সংহতি জানাচ্ছে সাধারণ মানুষ, তখনকার ইতিহাসের প্রতিটি মোচড় যেন দৃশ্যমান হয়ে আছে এখানে। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের নাগরিক ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতের আমির ঘোষণা করার পর পরই আসলে প্রতিরোধে সংহত হতে থাকে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের সচেতন মানুষ। ১৯৯২ সালের ৯ জানুয়ারি ৭ নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) কাজী নুরুজ্জামানের বাড়িতে জরুরি বৈঠক, ১৩ জানুয়ারি জননী সাহসিকা সুফিয়া কামালের বাড়িতে তাঁকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠনের উদ্যোগ এবং শারীরিক কারণে সুফিয়া কামালের প্রস্তাব, জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করা—এভাবেই এগিয়েছিল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও গণ-আদালতের কাজ। অসংখ্য ছবি ঘটনাগুলোকে মূর্ত করে রেখেছে।
আবার কেউ যদি পারিবারিকভাবে জাহানারা ইমামকে খুঁজে নিতে চান, তাহলেও নিরাশ হতে হবে না। তাঁর ড্রেসিং টেবিল, হারমোনিয়াম, লেখার টেবিল, ব্যবহৃত সবুজ টেলিফোন, বিছানা, ত্রিশ দশকের গ্রামোফোন, ক্যাসেট প্লেয়ার কিংবা রুমীর এয়ারগান পরিবারটি সম্পর্কে একটা ধারণা দেবে। আর একটি জায়গায় এসে দর্শক দেখতে পাবে ত্রিশ দশক থেকে দশকওয়ারি শহীদজননীর ছবি। দেখতে পাবে প্রতি দশকে কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে শহীদজননীর মুখাবয়ব। সত্তরের পরের ছবিগুলো বেদনায় নীল।
রুমী সম্পর্কে তাঁর বন্ধুদের স্মৃতিচারণা রয়েছে এক পাশে।
শহীদজননীর সাহিত্য সম্ভার দেখে তাঁর শৈল্পিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। লরা ইঙ্গেস ওয়াইল্ডারের তেপান্তরে ছোট্ট শহর, নদীর তীরে ফুলের মেলা বই দুটিতে তাঁর অনুবাদক্ষমতা টের পাওয়া যায়। এ ছাড়া বুকের ভেতর আগুন, নয় এ মধুর খেলা, ক্যানসারের সঙ্গে বসবাসসহ বইগুলো পড়ারও আগ্রহ জন্মাবে আপনার।
বিছানার পাশে থাকা মনিটরে একাত্তরের দিনগুলি থেকে লেখা উঠছে। সেগুলোর দিকেও চোখ আটকে যাবে আপনার। সারাটা ক্ষণ জাদুঘরে মৃদু আওয়াজে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়, ‘বাধ ভেঙে দাও’ আর ‘কারার ওই লৌহকপাট’ গানগুলি বেজেই চলেছে। গানের কথা ও সুর বলে যাচ্ছে, এ সুরই বাঙালির হৃদয়তন্ত্রীতে ঝংকার তোলা মূল সুর, যার কাছে ঋণী আমরা সবাই।