যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন

অরুণ বসু ছিলেন আগাগোড়াই কাজপাগল মানুষ
অরুণ বসু ছিলেন আগাগোড়াই কাজপাগল মানুষ

কারও বিপদের কথা শুনলে তিনি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। একবার ফরিদপুর থেকে এক সাংবাদিক ঢাকায় এলেন মুমূর্ষু অবস্থায়। সন্ত্রাসী হামলার শিকার সেই সাংবাদিকের কোথায় চিকিৎসা হবে, কোত্থেকে টাকা জোগাড় হবে, তা নিয়ে সে কী ছোটাছুটি! এভাবে অনেকের পাশে দাঁড়াতেন তিনি। নিজের হাতে টাকা না থাকলে মানুষের কাছে হাত বাড়াতেন। তাঁর বন্ধুরা জানিয়েছেন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে জমিজমা, সহায়–সম্পদ পর্যন্ত বিক্রি করেছেন তিনি।

তাঁর স্ত্রী কদিন আগে বলছিলেন, বিয়ের অল্প কদিন পর একদিন দেখেন, স্বামীর হাতে বিয়ের আংটিটা নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, এক বন্ধুর ভাই বিদেশে পড়তে যাবে, তাৎক্ষণিকভাবে কিছু টাকার ঘাটতি হয়েছিল। তাই তিনি হাতের আংটি খুলে দিয়েছেন।

অরুণদা নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুব একটা সচেতন ছিলেন না। কিন্তু অন্যের স্বাস্থ্যের বিষয়ে খোঁজ রাখতেন।

বলছি অরুণদার কথা। অরুণ বসু, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং প্রথমা প্রকাশনের সমন্বয়ক। ৭ অক্টোবর আমরা তাঁকে হারিয়েছি। প্রথমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে অফিসে এলেন। অফিসের নিচে দেখা হলো। বললাম, অফিসে এলেন কেন, বাসায় বিশ্রাম নিন। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ঠিক আছি। কিন্তু তাঁকে দেখে আমার ‘ঠিক’ মনে হয়নি। বেশ অসুস্থ মনে হলো। আসলে তিনি কাজপাগল মানুষ, তাই হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই অফিসে এসেছিলেন। এরপর আবার অসুস্থ হয়ে ৪ অক্টোবর ভর্তি হলেন হাসপাতালে। এবার কোভিডে আক্রান্ত হয়ে তিনি চলেই গেলেন।

আমি অরুণদাকে প্রথম দেখি প্রথম আলোতেই ১৯৯৯–র মে মাসে। আমার মাস দুয়েক আগে, মার্চে তিনি যোগ দিয়েছিলেন এখানে। শুরুতে দেখতাম, অরুণদা বিভিন্ন লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছেন আর ভুল বের করছেন। শিরোনাম, বানান, বাক্য ইত্যাদি ঠিক হলো কি না, খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতেন। আমাদের কাছে এসেও বলতেন কার কী ভুলভ্রান্তি। নানা পরামর্শও দিতেন। তাঁর প্রতিদিনের এ কাজে উৎসাহ দিতেন মতি ভাই (সম্পাদক মতিউর রহমান)। তখন অত কম্পিউটারের চল ছিল না। দাদা হাতে লেখা চিরকুট নিয়ে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ঘুরতেন। একসময় এটা মতি ভাইকে দেখাতেন। আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতাম, কখন কী ভুল হয়ে যায়। তখন ভয়–বিরক্তি থাকলেও এখন বুঝি, এটা কত বড় কাজ। এভাবে ছোট–বড় ভুল চিহ্নিত করে, শুধরে বড় হয়েছে প্রথম আলো। এ কাজটি নিখুঁতভাবে করতে দেখেছি অরুণদাকে।

এরপর একসময় তিনি বার্তা বিভাগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলেন। সংস্কৃতির খবর, শেষের পাতার বিশেষ ফিচারসহ নানা ধরনের লেখা, রিপোর্ট তিনি সম্পাদনা করে দিতেন। আর বড় লেখা ছোট করে দিতেন চোখের নিমেষেই।

অরুণদা নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুব একটা সচেতন ছিলেন না। কিন্তু অন্যের স্বাস্থ্যের বিষয়ে খোঁজ রাখতেন। প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘শরীর–স্বাস্থ্য ঠিক আছে তো!’ এভাবে কাজের মধ্য দিয়েই অরুণদা আমাদের সবার আপন হয়ে গেলেন। অরুণদা, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আপনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

  • লাজ্জাত এনাব মহছি: উপসম্পাদক