বিজয়ের মাস

যুদ্ধের হুংকার দিয়ে পালাল পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা

একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। আজ পড়ুন জামালপুরের কাহিিন

মিত্রবাহিনীর কমান্ডারের সঙ্গে জহুরুল হক মুন্সী বীর প্রতীক (মাঝে) l ছবি: জহুরুল হক মুন্সীর সৌজন্যে
মিত্রবাহিনীর কমান্ডারের সঙ্গে জহুরুল হক মুন্সী বীর প্রতীক (মাঝে) l ছবি: জহুরুল হক মুন্সীর সৌজন্যে

জামালপুর শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি ঘিরে ফেলেছে যৌথ বাহিনী। ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠান মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের। কিন্তু জামালপুরের গ্যারিসন কমান্ডার পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল সুলতান আহমেদ লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে যে ফিরতি চিঠি দেন, তার ভেতরে মুড়ে দেন ৭.৬২ মিলিমিটার বন্দুকের একটি বুলেট।
এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ চিঠি ক্ষিপ্ত করে তোলে মুক্তিসেনাদের। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বানসংবলিত চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন জহুরুল হক মুন্সী বীর প্রতীক। বললেন, পাকিস্তানি বাহিনীর ওই বুলেটের জবাব বুলেটের মাধ্যমেই দিয়েছিল যৌথ বাহিনী।

সেদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জহুরুল হক মুন্সী প্রথম আলোকে জানান, মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে এসে ভারতীয় এক সেনা বললেন, আত্মসমর্পণের আহ্বানসংবলিত চিঠি পৌঁছে দিতে হবে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে। কে যাবেন চিঠি নিয়ে? সাড়া মিলছিল না কারও। অনেকে বলছিলেন, তাঁরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হতে রাজি, কিন্তু খালি হাতে শত্রুশিবিরে যাবেন না। ‘কিন্তু আমি ভাবলাম, কাউকে না কাউকে তো যেতেই হবে। রাজি হয়ে গেলাম শত্রুঘাঁটিতে ঢুকতে।’ বলছিলেন জহুরুল হক মুন্সী।
জামালপুর শহরে পিটিআই চত্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি। ৯ ডিসেম্বর সাদা পতাকা হাতে সাইকেল চালিয়ে সেখানে ছুটলেন জহুরুল হক মুন্সী। তিনি বলেন, ‘বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমি চিঠি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে পৌঁছাই। চিঠি তুলে দিই লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদের হাতে। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমার ওপর নির্যাতন শুরু হয়। চার ঘণ্টা উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। রাত নয়টার দিকে ছেড়ে দেওয়া হয় আমাকে। হাতে তুলে দেওয়া হয় লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদের প্রত্যুত্তর।’
‘জামালপুরে আমরা যুদ্ধ শুরুর অপেক্ষায় আছি। যুদ্ধ এখনো শুরু হয়নি। কাজেই বাক্যব্যয় না করে যুদ্ধ শুরু করা যাক।’ ফিরতি চিঠিতে এমনটিই লিখেছিলেন পাকিস্তানি কমান্ডার সুলতান মাহমুদ। ওই চিঠি লেখার দুদিন পরেই ১১ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনারা। তবে ওই উদ্ধত চিঠির রচয়িতা কর্নেল সুলতান মাহমুদ সঙ্গীদের ফেলে ২০০ সেনা নিয়ে পালিয়ে যান।
জামালপুরের ওই লড়াইয়ের বর্ণনা পাওয়া যায় মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের ‘দ্য ব্যাটেল অব জামালপুর’ নিবন্ধে।

১০ ডিসেম্বর মধ্যরাতের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘাঁটি থেকে শহরের সড়কে নেমে আসে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দল। নেমেই একটানা গুলি চালাতে থাকে। উদ্দেশ্য মিত্রবাহিনীর অবস্থান জানা। কিন্তু পাল্টা গুলি চালানো থেকে বিরত থাকে মিত্রবাহিনী। এতে বিভ্রান্ত হয় পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের ধারণা হয়, মিত্রবাহিনীর সদস্যদের হয়তো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
রাত একটায় জামালপুরের ঘাঁটি থেকে সার বেঁধে বের হয়ে আসে পাকিস্তানি সেনারা। ওত পেতে থাকা মিত্রবাহিনীর অবস্থানের ২০ গজের ভেতরে চলে আসে তারা। মুহূর্তে গর্জে ওঠে মিত্রবাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র। পাকিস্তানি সেনাদের আর্তচিৎকারে ভেঙে খান খান হয়ে যায় শীতের রাতের নিস্তব্ধতা। ভোর পর্যন্ত চলে আক্রমণ।
১১ নভেম্বর সকাল ছয়টার দিকে কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর দেখা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাকিস্তানি সেনাদের মৃতদেহ। পরাভব মেনেছে পাকিস্তানি বাহিনী। ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে যান মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের। সেখানে ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর ওই ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর ফজলে আকবর। সঙ্গে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জাইদি ও ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজরসহ আট জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার। আরও ছিলেন বিভিন্ন পদমর্যাদার ৩৭১ জন সৈনিক। তাঁরা সবাই মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
জামালপুরের এই লড়াইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কর্মকর্তাসহ ২৩৪ জন নিহত হন। প্রাণ হারান মিত্রবাহিনীর ১০ জন সেনা।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন জামালপুর প্রতিনিধি আব্দুল আজিজ}