চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে কোয়াড নিয়ে বেইজিংয়ের অস্বস্তির কথা জানান। বেইজিংয়ের প্রস্তাবে মত দেয়নি ঢাকা
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারতসহ চারটি দেশের কৌশলগত অনানুষ্ঠানিক নিরাপত্তা সংলাপ বা কোয়াড নিয়ে চীন তার উদ্বেগের কথা বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বাইরের শক্তির এমন ‘সামরিক জোটের’ বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে পাশে পেতে চায় চীন। তবে চীনের প্রস্তাবে বাংলাদেশ কোনো সাড়া দেয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে কোয়াড নিয়ে বেইজিংয়ের অস্বস্তির কথা জানান। সেই সঙ্গে এ অঞ্চলে কোয়াড যাতে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে, সে জন্য দুই দেশের একসঙ্গে কাজ করার বিষয়েও বেইজিংয়ের প্রত্যাশা তুলে ধরা হয়েছে।
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের কৌশলগত জোট ‘কোয়াড’ নামে পরিচিত।
গত মঙ্গলবার প্রায় সাত ঘণ্টার সফরে ঢাকায় আসেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এ সময় তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পাশাপাশি সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। সফরের শুরুতে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এই প্রথম চীনের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শ্রদ্ধা জানাতে গেলেন। এমনকি ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এলেও তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে যাননি। এবার সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী চীনের গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রীর প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কোয়াড নিয়ে কোনো আলোচনা করেছিলেন কি না, তা নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে ২৭ এপ্রিল রাতে চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া ঢাকা থেকে ‘বাংলাদেশ, চীন সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাইরের কোনো শক্তির সামরিক জোট গঠনের চেষ্টা এবং আধিপত্য বিস্তার রুখতে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে দুই পক্ষের যৌথ প্রয়াস চালানো উচিত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত বৃহস্পতিবার তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে কোয়াডের প্রসঙ্গটি আলোচনায় তুলেছেন বলে জেনেছি। তিনি চীনের অবস্থানের কথা বলে গেছেন। তিনি যা বলেছেন, তা বাংলাদেশ সমর্থন করে এমনটা নয়। তিনি যা বলেছেন বাংলাদেশ শুনেছে। কৌশলগত উদ্যোগের বিষয়ে বাংলাদেশ সব সময় বলে আসছে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপাদান থাকলে বাংলাদেশ তাতে যুক্ত হবে। কোনো উদ্যোগে নিরাপত্তার বিষয়টি থাকলে বাংলাদেশ তাতে যুক্ত হবে না।’
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের একপর্যায়ে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি বেইজিং-দিল্লি এবং বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্কের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। এ সময় জেনারেল ওয়াং গালোয়ান উপত্যকায় ভারতের সঙ্গে গত বছরের সীমান্ত সংঘাতের প্রসঙ্গ টেনে উল্লেখ করেন, ভারত সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করায় সেখানকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তবে দুই পক্ষ আলোচনা করে সীমান্তে এখন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখেছে।
জানা গেছে, এরপর বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে গিয়ে জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি মার্চে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্যোগে আয়োজিত কোয়াড শীর্ষ নেতাদের ভার্চ্যুয়াল আলোচনার কথাটি তোলেন। অবাধ ও মুক্ত ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরের নামে চীনবিরোধী একটি জোট হচ্ছে বলে রাষ্ট্রপতির কাছে মন্তব্য করেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। মার্কিন উদ্যোগ ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের (ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি—আইপিএস) বিরোধিতার কোনো ইচ্ছে চীনের নেই। চীন এ অঞ্চলের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চায়। তাই উন্নয়নের স্বার্থে শান্তি ও স্থিতিশীলতা জরুরি। চীন কারও সঙ্গে সংঘাতে যেতে চায় না। তাই এ অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বাংলাদেশকে পাশে চায় চীন।
তবে সরকারের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এমন আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশার বিষয়ে রাষ্ট্রপতি কোনো মন্তব্য করেননি।
নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে সম্প্রতি দ্রুত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। দেশের স্বার্থ বজায় রেখে বিশেষ কোনো কৌশল বা উদ্যোগে যুক্ত হওয়াটা বাংলাদেশের জন্য সমীচীন হবে না। কারণ, এ অঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকাটা জরুরি। কাজেই কোনো পক্ষেরই আগ্রাসনমূলক ভূমিকা ও পদক্ষেপ থাকাটা সমীচীন হবে না।’
সাবেক এই জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা মনে করেন, কোয়াড যেভাবে এগোচ্ছে তাতে করে চূড়ান্তভাবে এটি সামরিক জোটে রূপ নিতে পারে। ভারত মহাসাগরে যাতে পুরোপুরি সামরিকীকরণ না হয়, সে ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।
চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরের আগে কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মন্তব্য করেছিলেন, কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন অনেক দেশ আবার টালমাটাল, তখন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিষয়ে সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকা সফর নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। জেনারেল ওয়েই ঢাকায় আসার দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নরভানে। এক বছরের বেশি সময় ধরে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্রুত ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের নানা প্রস্তুতি চলছে, যার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে বাংলাদেশও। আবার চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। সর্বশেষ টিকা নিয়ে সংকটের প্রেক্ষাপটে চীনের কাছ থেকে টিকা পেতে আলোচনা চলছে। আর ঢাকায় সংক্ষিপ্ত সফরের সময় দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার পাশাপাশি টিকা কূটনীতি আর পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতি নিয়ে কথা বলে গেলেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
১৯৭৭ সাল থেকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাপকতর প্রতিরক্ষা সহযোগিতা রয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য কেনা সমরাস্ত্রের বড় উৎস চীন। আর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম সাবমেরিনও কেনা হয়েছে চীন থেকে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ছাড়াও বিমানবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জন্য বিভিন্ন ধরনের সামগ্রীও চীন থেকে কেনা হয়েছে।
পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফর নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের (এসআইপিজি) জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবতার নিরিখে বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক অব্যাহত রাখা উচিত। পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতি আর মহামারির কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা বিবেচনায় নিয়ে কৌশলগত সহযোগিতার বিষয়টিকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কাজেই কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের সুফলের বিষয়টিকে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে।