প্রশিক্ষণ নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দেবে র্যাব
হেলিকপ্টার, গোয়েন্দা ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ সরঞ্জামসহ বিভিন্ন পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা
সফটওয়্যার বিক্রি না করার কথা জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্যার সমাধান চায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাব বলছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো না কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা অব্যাহত ছিল। তারা চায় সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বহাল থাকুক।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে গোটা বাহিনী, বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালকসহ সাতজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রায় দুই সপ্তাহ পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে এসব কথা বলেন। তাঁরা জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও রাজস্ব দপ্তরের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাহিনীর ভেতর অস্বস্তি আছে। এই নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিকতা নিয়ে যে যা–ই বলুক, র্যাব চায় সরকার এই অচলাবস্থার একটা সমাধান খুঁজে বের করুক। একটি প্রশিক্ষণ চালুর ব্যাপারে র্যাব যুক্তরাষ্ট্রকে শিগগিরই চিঠি দেবে বলেও জানা গেছে।
এদিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও সংস্থাটির সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনকে অনুরোধ জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনকে লেখা চিঠিতে আব্দুল মোমেন এ অনুরোধ জানান বলে আজ রোববার বলা হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন পুরো বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, র্যাবের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক আছে। র্যাব এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়।
ঠিক কোন কোন খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পেয়েছে র্যাব, জানতে চাইলে খন্দকার আল মঈন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ট্রেনিং অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের আওতায় ২০১১ সাল থেকে র্যাবের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন।
ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রথমে মার্কিন প্রশিক্ষকেরা বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে যান এবং অধিনায়কদের সঙ্গে কথা বলেন। পরের বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্টারনাল ইনকোয়ারি সেল কাজ শুরু করে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পাঁচটি ব্যাচ এই প্রশিক্ষণ পায়। প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল মানবাধিকার, মর্যাদা, অপরাধ তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের ধরন।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা র্যাবে ইন্টারনাল ইনকোয়ারি সেল গঠন করেছেন। এই সেলের তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় এখন পর্যন্ত পাঁচ শর বেশি র্যাব সদস্যের শাস্তি হয়েছে।
তা ছাড়া র্যাব জানায়, করোনাকালীন র্যাব দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের যে হেলিকপ্টারে বহন করেছে, সেটিও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা। বেল ৪০৭ নামের হেলিকপ্টারটি র্যাব ২০১২ সালে কেনে। চার ধাপে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই হেলিকপ্টারের খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ১৪ জন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন।
জঙ্গি দমন ও মাদক অভিযানে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সরঞ্জাম, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ও মাদক শনাক্ত করার জন্য সরঞ্জামও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা হয়েছে।
এ সময় আট ধাপে ২২ জন সদস্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ নেন।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র বলেছে, র্যাব ও র্যাবের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনায় সদস্যদের মধ্যে কিছু প্রশ্ন ও অস্বস্তি আছে।
একটি সফটওয়্যার কেনার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে র্যাবের কথা হচ্ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান র্যাবের কাছে সফটওয়্যার বিক্রির সিদ্ধান্ত বাতিলের কথা জানিয়েছে।
কোনো কোনো কর্মকর্তার স্বজন লেখাপড়ার জন্য কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তাঁদের কাছে টাকা পাঠানো বা তাঁদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ায় প্রতিবন্ধকতা হতে পারে, এমন আশঙ্কা আছে কারও কারও। কোনো কোনো কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার কথা এবং তাঁদের ভিসা রয়েছে। এই ভিসা আর কার্যকর থাকবে কি না, তা–ও অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, র্যাব নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে, এমন ইঙ্গিত ছিল আগে থেকেই। এমনকি গত বছরের অক্টোবরেও রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটের ১০ সিনেটর পররাষ্ট্র ও রাজস্ব দপ্তরের কাছে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি পেশ করেছিলেন।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পুরোনো। র্যাব গঠনের ১০ মাসের মাথায় ২০০৫ সালে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের এক ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তারবার্তায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে একজন কর্মকর্তা সে সময় লিখেছিলেন, ২০০৭ সালের নির্বাচনসহ মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে র্যাবের কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়তে পারে। “পুলিশের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার’-এ মৃতের সংখ্যা বাড়ছে এবং র্যাব ক্রসফায়ারে হত্যার সংখ্যা ১০০ ছাড়াতে যাচ্ছে” এই ছিল ওই তারবার্তার শিরোনাম।
র্যাব কর্মকর্তাদের প্রশ্ন ২০০৫ সালে উদ্বেগ প্রকাশের এত বছর পর এই নিষেধাজ্ঞা কেন। কিন্তু যে কারণেই এই নিষেধাজ্ঞা আসুক, র্যাব চায় কূটনৈতিকভাবে এর সমাধান হোক। তাদের আশঙ্কা, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আরও নানান ঝামেলা তাদের পোহাতে হতে পারে।
২০০৭-১০ সাল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন হাসান মাহমুদ খন্দকার। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের কথা বলেছে মার্কিন পররাষ্ট্র ও রাজস্ব দপ্তর। এই অভিযোগগুলোর তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন কি না। জবাবে স্পেনে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উল্লেখ করতে পারত। তারা বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। কূটনৈতিক আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়গুলো নিয়ে দুই দেশ কথা বলতে পারত।
তিনি র্যাবের মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুমের ঘটনা ঘটেছে কি না, জানতে চাইলে হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু সেটা বিচারবহির্ভূত কি না, তা বলবেন আদালত। আগেই কোনো ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলার সুযোগ নেই। অভিযানে গেলে অনেক ঘটনাই ঘটে। কেউ কেউ অপরাধমূলক ঘটনায় জড়াতে পারে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। তবে ঢালাওভাবে অভিযোগ দেওয়া ঠিক না।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে একরামুলসহ কমপক্ষে সাতজনের মৃত্যুর ঘটনা খতিয়ে দেখতে এবং এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান কী, তা জানতে চেয়েছিল মার্কিন সরকার। এ ছাড়া সিনেটররা গত বছর ৪০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে র্যাবের যে কার্যক্রম, তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ ও বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিকে হুমকির মুখে ফেলছে।
নিষেধাজ্ঞা আরোপসংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও মার্কিন রাজস্ব দপ্তর বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) বরাত দিয়ে বলে, র্যাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০০টির বেশি গুম, ২০১৮ সাল থেকে ৬০০ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও র্যাব-৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহউদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র দপ্তর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হককে হত্যায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে। পুলিশ দাবি করছে, এ ঘটনায় বিচারপ্রক্রিয়া চলমান। যদিও একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।