আজ ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। পদ্মা সেতু চালুর পর বর্ধিত যানবাহন ব্যবস্থাপনা ও সড়ক নিরাপত্তায় কেমন ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, ঢাকা শহরের অবস্থা কেমন হতে পারে—এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদ্দাম হোসাইন।
প্রথম আলো: দক্ষিণাঞ্চলে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। পদ্মা সেতু চালুর পর দুর্ঘটনা বৃদ্ধির শঙ্কা আছে?
হাদিউজ্জামান: ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের ৫৫ কিলোমিটার এলাকায় শুধু ২০২১ সালেই দুর্ঘটনায় ৭৬ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছে তিন শতাধিক, যাঁদের অধিকাংশই পথচারী। এর বাইরে আরও ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার প্রকৃত হিসাব নেই। সচেতনতার অভাব, যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো–নামানো করানো, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সময় পথচারীদের গুরুত্ব না দেওয়াই এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ। এমন দুর্ঘটনার কারণে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের ‘বদনাম’ হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালুর পর ওই এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই যানবাহন চলাচল বাড়বে। এতে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে।
অপ্রাপ্তবয়স্করা যাতে এক্সপ্রেসওয়ে ‘রেসিং ট্র্যাক’ হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কাউকে এক্সপ্রেসওয়েতে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
কীভাবে সড়কে এমন দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
হাদিউজ্জামান: এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে দুই পাশে থাকা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা সামাজিকভাবে যুক্ত। তাই তাঁদের নানা প্রয়োজনে সড়ক পারাপার হতে হচ্ছে। তাঁদের পারাপার সহজ করতে এক্সপ্রেসওয়ের ৫০০ মিটার পরপর ওভারপাস বা আন্ডারপাস তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। অপ্রাপ্তবয়স্করা যাতে এক্সপ্রেসওয়ে ‘রেসিং ট্র্যাক’ হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কাউকে এক্সপ্রেসওয়েতে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
পদ্মা সেতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আর কী অবকাঠামো করা যেতে পারে?
হাদিউজ্জামান: বর্তমান এক্সপ্রেসওয়েটিকে আমরা ‘ফরওয়ার্ড লিংক’ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এর মাধ্যমে ঢাকা বা দক্ষিণাঞ্চল থেকে দ্রুত পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে। কিন্তু এরপর যে সড়ক দিয়ে যানবাহন যাতায়াত করবে অর্থাৎ ‘ব্যাকওয়ার্ড লিংকের’ অবশ্যই উন্নয়ন করতে হবে। নইলে পদ্মা সেতুর সার্বিক সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে না। কারণ, পদ্মা সেতুর কারণে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে। নতুন যানবাহনের চাহিদা পূরণে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ঢাকা শহরের চারপাশ ঘিরে ৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রিং রোডকে। সেটি এখনো নির্মাণ করা হয়নি। আবার ভাঙ্গা পার হওয়ার পর খুলনা, যশোর বা এর আশপাশের এলাকায় যাওয়ার সড়ক এখনো দুই লেনের। ফলে ঢাকার প্রবেশমুখ ও দক্ষিণাঞ্চলের দুই লেনের সড়কে যানজট বাড়তে পারে।
পদ্মা সেতু চালু হলে লঞ্চ, ফেরিঘাট ও স্পিডবোট কি গুরুত্ব হারাবে?
হাদিউজ্জামান: সেতু চালুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক, রেল ও নৌপথে যোগাযোগ করা যাবে। এতে নৌপথের চাহিদা কিছুটা কমলেও একেবারে গুরুত্বহীন হয়ে যাবে না। কারণ, নৌপথে যাত্রী ও মালামাল বহনে খরচ কম। এমন অনেক যাত্রী আছেন, যাঁদের কাছে সময়ের চেয়ে আর্থিক সাশ্রয় বড় বিষয়। তা ছাড়া সার্বিকভাবে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন চাইলে সড়ক, রেল ও নৌপথ—তিনটিকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
পদ্মা সেতু ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়ন হতে পারে। এ অবস্থায় সরকারের করণীয় কী?
হাদিউজ্জামান: পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক শিল্পায়ন যাতে অপরিকল্পিত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এখনই দক্ষিণাঞ্চলসহ পদ্মা সেতুর আশপাশের এলাকার ভূমি ব্যবস্থাপনার নীতিমালা তৈরি করতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও জমির মূল্যসংক্রান্ত নীতিমালা করতে হবে, যাতে হু হু করে জমির দাম না বাড়ে।
পদ্মা সেতুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ঢাকা শহর কি প্রস্তুত?
হাদিউজ্জামান: সে অর্থে ঢাকার প্রস্তুতি নেই। ঢাকার চারপাশের রিং রোড হয়নি। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে যাতায়াতকারী যানবাহন ঢাকা শহর হয়ে যাবে। আবার ঢাকায় যেসব যানবাহন আসবে, সেগুলো যাত্রাবাড়ী দিয়ে ঢুকবে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতিদিন পদ্মা সেতু হয়ে ২০ হাজার যানবাহন চলাচল করবে, ১০-১৫ বছর পর যানবাহনের সংখ্যা ৪০ হাজার হবে। তাই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ঢাকায় রিং রোড নির্মাণের কাজ শেষ করতে হবে।
প্রথম আলো: তাহলে কি ঢাকার যানজট পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে?
হাদিউজ্জামান: যানজট পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে। দ্রুত ঢাকা শহরের ৪২টি রুটে ‘ঢাকা নগর পরিবহনের’ আদলে কোম্পানিভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করতে হবে। অবৈধ, ফিটনেসবিহীন ও অযান্ত্রিক যানবাহন তুলে দিতে হবে।
হাদিউজ্জামান, অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়