যশোরে আড়াই মাসে ২৯টি 'বন্দুকযুদ্ধ'

যশোরে গত আড়াই মাসে পুলিশের সঙ্গে ২৯টি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের হিসাবে, এসব ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুজন নিহত ও ২৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
তবে গুলিবিদ্ধ তিনজন প্রথম আলোকে বলেছেন, পুলিশ তাঁদের ধরে নিয়ে পায়ে গুলি করেছে। বন্দুকযুদ্ধের কোনো ঘটনা ঘটেনি। বাকি আহত ব্যক্তিদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ফলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় একাধিক মানবাধিকারকর্মী বলছেন, ঘটনাগুলো অমানবিক।
জেলার বিএনপি ও জামায়াত নেতারা দাবি করেছেন, রাজনৈতিক নিপীড়নের অংশ হিসেবে তাঁদের কয়েকজন নেতা-কর্মীকে ধরে নিয়ে পায়ে গুলি করা হয়েছে। তাঁরা কেউই অপরাধী নন। তবে স্থানীয় পুলিশ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পুরো পরিস্থিতি জানিয়ে এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকারের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, যশোরের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত না শুনে এ বিষয়ে তাঁর কোনো বক্তব্য দেওয়া ঠিক হবে না।
যশোর পুলিশের মুখপাত্র সহকারী পুলিশ সুপার রেশমা শারমীন গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানান, ২৫ মার্চ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত যশোর জেলায় ২৯টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় দুজন নিহত হয়েছেন ও ২৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহত দুজন হলেন অভয়নগর উপজেলার সাইফুল ইসলাম (৩০) ওরফে শিকারি সাইফুল এবং যশোর সদরের ঝুমঝুমপুর এলাকার তাহের মোল্লা (৪০)। তাঁদের মধ্যে সাইফুলের বিরুদ্ধে ডাকাতি-খুনসহ একাধিক মামলা রয়েছে। আর তাহের পাঁচটি মাদক ও একটি হত্যা মামলার আসামি।
তাহের মোল্লার বোন জরিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত ১০টার দিকে ঝুমঝুমপুর এলাকার একটি হোটেলে রাতে খাওয়ার সময় পুলিশ তাহেরকে নিয়ে যায়। রাতেই থানায় খবর নিয়ে জেনেছি, তাকে আটক করা হয়নি। সকালে জানতে পারলাম পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে।’
যশোর জেনারেল হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ২৯ মে রাতে পুলিশ পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাহেরকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের কারণে কিছুক্ষণ পরে তিনি মারা যান। তবে নিহত ব্যক্তির বোন এটা মানতে চান না। জরিনা বলেন, ‘পায়ে গুলি করলে তো কেউ মরে না। পুলিশ বুট পায়ে দিয়ে মাড়িয়ে নির্যাতন করে তাকে মেরে ফেলেছে। পরে গুলি করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। তার বুক ও হাতে থেঁতলানোর চিহ্ন ছিল।’
নিহত শিকারি সাইফুলের স্বজনেরা এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
বাকি গুলিবিদ্ধ ২৭ ব্যক্তির মধ্যে ১৮ জনের সম্পর্কে পুলিশ ও হাসপাতাল থেকে তথ্য মিলেছে। তাঁদের মধ্যে গত ২৬ মার্চ মনিরামপুর উপজেলার সুন্দলপুর গ্রামের মিজানুর রহমান (৩০), ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় যশোর শহরের খড়কি বামনপাড়া এলাকার বাসিন্দা জেলা ছাত্রলীগের সহ-অর্থ সম্পাদক হাফিজুর রহমান ওরফে হাফিজ (২৮), ৩০ এপ্রিল ভোরে সদর উপজেলার কচুয়া গ্রামের মজনু (৩৫), একই দিনে মনিরামপুর উপজেলার আগরহাটি এলাকায় রফিকুল ইসলাম (৩০), ২৮ এপ্রিল ছাত্রশিবিরের যশোর জেলার পশ্চিমাংশের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন (২৫) ও শিবিরের বেনাপোল পৌর কমিটির সভাপতি আবুল কাসেম (২১), ২৭ এপ্রিল যশোর শহরের চাঁচড়া রায়পাড়া এলাকার আনোয়ার হোসেন (২৩), ২২ এপ্রিল যশোর সদর উপজেলার বাওলিয়া গ্রামের বাসিন্দা জামায়াতের কর্মী মোছাইদ হোসেন (৩০), ৮ এপ্রিল শার্শা উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের মনু মিয়া (৪৫) গুলিবিদ্ধ হন। আর ২ মে শার্শা উপজেলার মহিষাডাঙ্গা গ্রামে রফিকুল ইসলাম (৩২), ৪ মে যশোর শহরের রেলগেট এলাকার আরিফ হোসেন ওরফে সুমন (৩৬) ও একই এলাকার রানা (২৮), ৭ মে মনিরামপুর উপজেলার জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা জামায়াতের কর্মী আলী কদর (২৮), ১৫ মে ইসলামী ছাত্রশিবির যশোর শহর শাখার সভাপতি জাহিদুল ইসলাম (২৯) ও রেলগেট এলাকার আবুল কাসেম (২৫), ৩১ মে সদর উপজেলার বারান্দি মোল্লাপাড়া এলাকার মাসুদুর রহমান ওরফে নান্নু (৩৮) ও সর্বশেষ গত ১৫ জুন শহরের ষষ্ঠীতলাপাড়ার বাসিন্দা সালমান শিকদার ওরফে বিকি (২৮) এবং রেলগেট এলাকার ইব্রাহিম হোসেন ওরফে ডলার (২৪) গুলিবিদ্ধ হন।
গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের পা কেটে ফেলার তথ্য পাওয়া গেছে। বাকিদের কেউই এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সুস্থ হননি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আহত এসব ব্যক্তিকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
হাফ দেব, না ফুল দেব: ৩১ মে যশোরে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হন মাসুদুর রহমান ওরফে নান্নু নামের এক তরুণ। চিকিৎসাধীন মাসুদুর নিজেকে

তরুণ লীগের যশোর শহর শাখার যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দেন। মাসুদুরের বাঁ পায়ের হাঁটুর সংযোগস্থলে গুলি করা হয়।
তবে এলাকাবাসী জানিয়েছেন, মাসুদ এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ফিঙে লিটনের সহযোগী। ফিঙে লিটন ভারতে বসে ইন্টারনেটের স্কাইপ ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করে থাকেন। আর মাসুদুর এ কাজে তাঁকে সাহায্য করেন। মাসুদুরের বিরুদ্ধেও হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
গুলির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মাসুদুর জানান, গত ৩১ মে যশোরের মনিহার সিনেমার সামনে ফলের আড়ত থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় যশোর কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শোয়েবউদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল।
মাসুদুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিকেল বেলা। এক কাপ চা নিয়ে আমি এক চুমুক দিছিমাত্র। একটা মাইক্রোবাস আইসে থামল। এসআই শোয়েবসহ পাঁচজন নামলেন। আমারে কলো, চল। আমি কলাম, ক্যান, আমি কী করছি। এরপরে পুলিশে গালি দেওয়া শুরু করল। দুজন দুই পাশে ধরে চেয়ার থেকে উঠায় পিছমোড়া করে হাতে হ্যান্ডকাফ বাইন্ধে ফেলল। আলগায়া চারজন মিলে গাড়িত উঠাল। তহন এসআই শোয়েব ফোনে কথা কচ্ছিল। ফোনে অইপারের লোকরে কয়, “হাফ দেব, না ফুল দেব।” আমি তো বুইঝে ফেলছি, আমারে ক্রস দেওয়ার কথা কইতেছে। আমি নানাভাবে অনুরোধ করি। তহন এক সেপাই আমারে কয় আল্লারে ডাক, স্যারে কিন্তু মাইরে ফেলে দেবেনে। প্রথমে আমারে নড়াইল রোডে নিল, তারপরে নিল ভাতুড়িয়ার দিকে। গাড়িতেই আমার জিনসের প্যান্টের বাঁ পা ব্লেড দিয়া কাইটে ফালাইলো তারা। হেই প্যান্টই দড়ির মতো বানায়ে আমার রানে আর হাঁটুর িনচে বানল। এসআই শোয়েব সিপাইদের কয়, গুলির পর যেন আমার হ্যান্ডকাফ খুলে দেয়। আমি সব শুনতাছি, বুঝতাছি। কিছু করতে পারতেছি না। এর মধ্যেই আমার ফ্যামিলিতে ফোন দেওয়াইছে। কইছে ৫০ লাখ টাকা দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত আমার আব্বা পাঁচ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়েছে। তহন আবার এসআই শোয়েবে কয় তোর জন্য তদ্বির হচ্ছে খুব। তয় আমি তোরে টাইম দেব না নে। তারপর একটা মাঠের মতো জায়গায় গিয়া গাড়ি থামল। আমারে নামায়েই পায়ে একটা গুলি কইরে দিল। আর হ্যান্ডকাফ খুলে দিল। তহন একজন পায়ের গুলি করা জায়গা দেইখা কয়, “কী গুলি করলেন, পায়ের মালাই তো উড়ে নাই, আবার করেন।” এরপর দুজন দুই পাশে ধরে আমারে উঠাইল, আরেকজন অস্ত্র ঠেকায়া হাঁটুতে আবারও গুলি করল।’
এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই শোয়েবউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, মাসুদুর নিজের যে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক পরিচয় দিয়েছেন সবই মিথ্যা। মাসুদুর এলাকার একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তাঁর বিরুদ্ধে ২০১০ সাল থেকে ১৪টি মামলা রয়েছে। এলাকায় সে ‘বেড়ে নান্নু’ নামে পরিচিত। আরও কিছু বিষয় জানতে চাইলে এসআই শোয়েবউদ্দীন জেলা পুলিশের মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
গুলিতে পা হারানো সালমান শিকদারের বাবা বাবু শিকদারের অভিযোগ, ১০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে না পেয়ে পুলিশ তাঁর ছেলের পায়ে গুলি করেছে। একই অভিযোগ গুলিবিদ্ধ ইব্রাহিম হোসেনেরও। তিনি বলেন, কোনো বন্দুকযুদ্ধ নয়, পুলিশ ধরে তাঁর পায়ে গুলি করেছে। এই দুজনকে নিয়ে গত ২৩ জুন প্রথম আলোয় খবর প্রকাশিত হয়।
তবে পুলিশ সূত্র ও এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের বেশির ভাগই এলাকায় ছোট-বড় অপরাধী হিসেবে পরিচিত। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
যশোরের মানবাধিকার সংস্থা রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু গুলি করলেই তো আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হবে না। আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ গুলি করতেই পারে। সেটা ভিন্ন বিষয়। এখানে পুলিশ যেটা করছে, সেটি অমানবিক। ধরে নিয়ে গুলি করা হচ্ছে।’
রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিযোগ: যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাবেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ যাঁদের গুলি করেছে, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। শুধু রাজনৈতিক নির্যাতনের অংশ হিসেবে কয়েকজনকে গুলি করে উল্টো মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যশোরে শিবিরের কয়েকজন নেতাকেও এভাবে ধরে নিয়ে গুলি করা হয়েছে। মনিরামপুরের ইস্রাফিল নামের এক তরুণকে গুলি করা হয়েছে। পরে তাঁর পা কেটে ফেলতে হয়েছে।
জেলা জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মো. সাহাবুদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, এ পর্যন্ত জামায়াত ও শিবিরের ছয়জনকে ধরে নিয়ে গুলি করেছে পুলিশ। সদর উপজেলা শিবিরের (পূর্ব) সভাপতি সোলায়মান কবিরকে পায়ে গুলি করা হয়েছে। তাঁর অবস্থা এখনো খারাপ। শিবিরের শহর শাখার সভাপতি জাহিদুল ইসলামকে পায়ে গুলি করা হয়েছে। তাঁরা কেউই অপরাধী নন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী।
তবে যশোরের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিযোগটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। প্রকৃত বন্দুকযুদ্ধেই এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।’ ধরে নিয়ে গুলি করার অভিযোগের বিষয়ে কে এম আরিফুল হক বলেন, ‘যারা বলছে ধরে নিয়ে গুলি করা হয়েছে, তাদের প্রোফাইল দেখেন না কেন। একেকজনের বিরুদ্ধে হত্যা, দস্যুতাসহ কতগুলো মামলা রয়েছে।’
দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি সন্ত্রাসী বা ডাকাত যেই হোক না কেন, তাকে পরিকল্পিত বা ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করার এই ঘটনাগুলো দেশে যে আইনের শাসন নেই তার ভয়াবহ প্রকাশ। বছরের পর বছর এ ধরনের ঘটনা আমাদের রাষ্ট্রকে একটা আইনবিহীন সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করে ফেলেছে বললেই চলে। আরও ভয়াবহ হলো, দেশ পরিচালনায় নিযুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা এর পরিণতি উপলব্ধি করতে পারছেন না।’