মাদারীপুরে বানরের উৎপাতে অতিষ্ঠ মানুষ। খাবারের জন্য মানুষকে বিরক্ত করে। কারও কারও বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় বানরগুলো। এগুলোর উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে প্রশাসন বা পুলিশের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারতেন তাঁরা। কিন্তু তা না করে খাবারে বিষ মিশিয়ে বানরকে খেতে দিয়েছেন। ওই খাবার খেয়ে একটি বা দুটি বানর নয়, অন্তত ১৫টি বানর মারা গেছে। গতকাল মঙ্গলবার এই মর্মান্তিক ঘটনাই ঘটেছে মাদারীপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যখাগদী এলাকায়।
মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মাদারীপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যখাগদী এলাকা থেকে ১৫টি বানরের মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয় কয়েকজন তরুণ। সন্ধ্যার পর তাঁরা বানরের মরদেহগুলো একটি খালপাড়ে মাটি খুঁড়ে চাপা দেন।
খাবারে বিষ মিশিয়ে বানর হত্যার ভিডিও ও ছবি ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ওই ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, কয়েকজন তরুণ একটি খালের পাড়ে একসঙ্গে মৃত বানরগুলো সারিবদ্ধভাবে রেখে মাটি খুঁড়ে চাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। অনেকেই সেই ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করে এই ঘটনার বিচার দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয় ও বন বিভাগের সূত্র জানায়, মাদারীপুর সদরের পৌর এলাকার ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে অন্তত আড়াই হাজার বানর রয়েছে। এই বানরগুলো খাবার-সংকটে এখন বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বানরের খাবার-সংকট থাকার পর সম্প্রতি ৭৬ দিনের একটি কর্মসূচি চালু করে সরকার। ওই কর্মসূচি চলতি সপ্তাহে শেষ হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, খাবারের তীব্র সংকট দেখা দেওয়ায় বানরগুলো কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে লোকালয়ে বসবাস শুরু করে। এর মধ্যে কিছু বানরকে স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছায় সকাল-বিকেল খাবার দেন। তবে কিছু অভুক্ত বানর খাবার না পেয়ে মানুষের বাড়িতে প্রায়ই হানা দেয়। কখনো কখনো ঘরে ঢুকে খাবার ছিনিয়ে খায়। এই উৎপাত সহ্য করতে না পেরে অনেকেই বানরগুলোকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারলে বানরগুলো ভয়ে পালিয়ে যায়।
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকেই খাবারের আশায় বানরগুলোর উপদ্রব বাড়তে থাকে মধ্যখাগদী এলাকায়। এরপর স্থানীয় কয়েকজন বানরের উৎপাত থেকে বাঁচতে খাবারে বিষজাতীয় কিছু মিশিয়ে বানরদের খেতে দেয়। ওই খাবার খেয়ে বানরগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বানরের মুখ থেকে রক্ত বের হতে দেখে স্থানীয় কয়েকজন তরুণ বানরের সামনে গিয়ে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। এই সময় যন্ত্রণায় ছটফট করছিল বানরগুলো। কিছুক্ষণ পর সব বানর মারা গেলে তাঁরা মরদেহগুলো একটি খালপাড়ে নিয়ে মাটি খুঁড়ে চাপা দেন।
বানরগুলোকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন মধ্যখাগদী এলাকার অপু হাওলাদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বানর তো আমাদের বাড়িতে এসে জ্বালায়। অনেক সময় তাদের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে কখনো কখনো ইট-পাটকেল ছুড়ে মারি। আবার ঘর থেকে খাবার এনে ওদের নিজ হাতে খাওয়াই। কিন্তু বানরগুলোকে কেউ বিষ খাওয়াইয়া একবারে মেরে ফেলতে পারে, তা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।’
একই এলাকার ইয়ারসিন হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল) যখন বানরগুলোকে বাঁচাতে ওদের মুখে পানি দিই, তখন আমাদের চোখেই পানি চলে আসে। আমরা বানরগুলোকে বাঁচাতে পৌরসভা ও বন বিভাগকে জানাই। কিন্তু তারা অনেক দেরি করে এখানে আসে। তারা এখানে যখন পৌঁছায়, তখন ১৫টি বানর মরে যায়। সন্ধ্যার পর আমরা ১৫টি বানরকে মাটিচাপা দিই। এখনো অনেক বানর আছে, যারা ওই খাবার খেয়ে অসুস্থ অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে পড়ে রয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী সুবল বিশ্বাস বলেন, ‘শুধু বানর বলে নয়, প্রতিটি পশুর প্রতি মানুষের আচরণ ভালো হওয়া উচিত। প্রাণীরা আমাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোনো মানুষ যদি পশুপাখির প্রতি সহানুভূতি না দেখাতে পারে, তাহলে সেই মানুষ অন্য মানুষের প্রতিও সহানুভূতি দেখাতে পারবে না।’
খাবারে বিষ দিয়ে বানরনিধনের খবর শুনে বন বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জানতে চাইলে মাদারীপুর জেলার ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা তাপস কুমার সেনগুপ্ত মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আজ (গতকাল) বিকেলে বানরদের খাবার দিয়েছি। তিন মাস ধরে খাবার দেওয়া হচ্ছে। খাবারের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যাঁরা বিষ প্রয়োগ করে বানরগুলোকে মেরেছেন, তাঁরা জঘন্যতম অপরাধ করেছেন। রাতে আমাদের বন বিভাগের লোক ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেছেন। যাঁরা এ কাজটি করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া আমি বিষয়টি স্থানীয় সাংসদ শাজাহান খান, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়েছি।’