যত 'ট্রিপ' তত টাকা

মোটরসাইকেল ও পণ্যবাহী ট্রাকের সংঘর্ষে মোটরসাইকেলচালকসহ তিন আরোহী আহত হন। ট্রাকের নিচ থেকে মোটরসাইকেল উদ্ধারের চেষ্টা করছেন পুলিশের সদস্যরা। গতকাল সকালে বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কের বেতগাড়ী এলাকায়। ছবি: সোয়েল রানা
মোটরসাইকেল ও পণ্যবাহী ট্রাকের সংঘর্ষে মোটরসাইকেলচালকসহ তিন আরোহী আহত হন। ট্রাকের নিচ থেকে মোটরসাইকেল উদ্ধারের চেষ্টা করছেন পুলিশের সদস্যরা। গতকাল সকালে বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কের বেতগাড়ী এলাকায়।  ছবি: সোয়েল রানা
>
  • সড়কে বিশৃঙ্খলা
  • প্রায় পাঁচ মাস আগে চালকদের সঙ্গে চুক্তিতে বা ট্রিপে বাস চালানো বন্ধের সিদ্ধান্ত হয় 
  • এটি কার্যকর হয়নি

নিরাপদ সড়কের দাবিতে গত বছরের আগস্টে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় পরিবহন মালিক সমিতি রাজধানীতে চুক্তিতে বাস চালানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু নিজেদের নেওয়া সিদ্ধান্ত প্রায় মাসেও কার্যকর করতে পারেননি পরিবহনমালিকেরা। রাজধানীর অধিকাংশ বাস এখনো চলছে চুক্তি ভিত্তিতে।

চুক্তিতে বাস চালানো বন্ধ করে চালক ও চালকের সহকারীদের মাসিক বা দৈনিক বেতন এবং নিয়োগপত্র দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল মালিক সমিতি। কিন্তু আগের মতোই চুক্তিতে বা ট্রিপ (যাত্রার শুরু থেকে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত) বাস চালাচ্ছেন মালিকেরা। ট্রিপ অনুযায়ী চালকেরা মালিকের কাছ থেকে টাকা পান। বেশি ট্রিপ দিতে পারলে টাকা বেশি। ফলে যাত্রী এবং ট্রিপের জন্য চালকেরা রাস্তায় বেপরোয়া থাকেন। একই রুটের (পথ) অন্য পরিবহনের সঙ্গেও এ কারণেই রেষারেষি করেন চালকেরা।

এ বিষয়ে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, মালিক সমিতির নেতাদের সিদ্ধান্ত সমিতির সদস্যরাই মানছেন না। চালক ও সহকারীর বেতন নির্ধারণের পাশাপাশি মালিকের জমাও নিশ্চিত করতে হবে। মালিক সমিতি, বাস মালিক, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার লোকজন বসে বেতন বা মজুরি নির্ধারণ করতে পারেন।

চুক্তিতে বাস চালানো বন্ধ করতে না পারার জন্য পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা দাবি করছেন, চালক ও সহকারীরা একই মালিকের বাস প্রতিদিন চালান না। ফলে চালক ও সহকারীর নিয়মিত বা মাসিক বেতন নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব। বেতন নির্ধারণের পাশাপাশি চালকদের নিয়োগপত্র দেওয়া, ভাড়ার টাকা মালিক সঠিকভাবে যাতে পায়, সে জন্য টিকিট কাউন্টার স্থাপন করাসহ আরও বেশ কিছু কাজ করতে হবে।

আবদুল্লাহপুর থেকে বছিলা রুটে (পথে) চলাচল করা প্রজাপতি পরিবহনের চালক খালেক মিয়া বলেন, ‘আগে বাস চালাতাম জমা হিসাবে। দিনের শেষে মালিককে জমার টাকা বুঝিয়ে দিতে হতো। জমার টাকা, গ্যাস, লাইন খরচ তোলার পরে নিজের আর হেলপারের (সহকারী) আয় তোলা লাগত। এখন ট্রিপ হিসাবে টাকা দেয়। কিন্তু ট্রিপ কম হলে আয় কম।’

গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৮ আগস্ট পরিবহন মালিক সমিতি ঘোষণা দেয়, ৯ আগস্ট থেকে চুক্তিতে গাড়ি চালানো হবে না। কোনো মালিক চালকের সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি চালালে ওই কোম্পানির সমিতির সদস্যপদ বাতিল করা হবে। চালক নিয়োগ দিয়ে গাড়ি রাস্তায় নামাতে হবে।

নবীনগর থেকে মিরপুর ১৪ নম্বর রুটের ইতিহাস পরিবহন, ধামরাই থেকে গুলিস্তানগামী সাভার পরিবহন, কদমতলী থেকে মিরপুর চিড়িয়াখানা রুটের দিশারী পরিবহন, গাবতলী থেকে মতিঝিল রুটের গাবতলী লিংক পরিবহনের অন্তত ১০টি বাসের চালক ও সহকারীর সঙ্গে গতকাল শুক্রবার কথা বলে প্রথম আলো। তাঁরা জানান, মালিক সমিতির নির্দেশেই তাঁরা ট্রিপে গাড়ি চালাচ্ছেন। তাঁদের কারও বেতন নির্ধারিত না। যত ট্রিপ তত টাকা এই চুক্তিতে তাঁরা বাস চালাচ্ছেন।

জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, কোনো চালক পুরো মাস একই মালিকের বাস চালান না। তাই মাসিক বেতন নির্ধারণ কঠিন। তাই ট্রিপ ভিত্তিতে দৈনিক একটি মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে বেপরোয়া চালানো অনেকটাই কমছে বলে দাবি করেন তিনি।

তবে মালিকদের ধারণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন অনেক বাসচালক। তাঁরা মনে করেন, চালকদের দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করলে বেপরোয়া বাস চালানো বন্ধ হবে। গাবতলী লিংক পরিবহনের চালক মো. ওহিদুল বলেন, ‘চালকেরা একই মালিকের বাস নিয়মিত চালায় না এটা ঠিক। মাসিক বেতন নির্ধারণ না করতে পারলে দৈনিক মজুরি ঠিক করুক। এক দিন কাজ করলে চালক ওই দিনের টাকা পাবে অন্তত এই নিশ্চয়তা থাকবে। তাহলে আর রাস্তায় পাড়াপাড়ি করবে না কোনো চালক।’