করোনাকালের জীবনগাথা

যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

বহুদিন পর আজ (৩১ মে) অফিস খুলেছি আমরা। সকালে অফিসের নিচে এসে সামাজিক দূরত্বের লাল মার্ক দেখে ভালো লাগল। লিফটে চড়ে লেবেল ১০-এ আমাদের অফিসের লবিতে নামতেই চোখমুখ ঢাকা এক লোক পিস্তলসদৃশ একটা বস্তু আমার মাথার দিকে তাক করলেন।

আমি কিছুটা হকচকিয়ে উঠলাম। পরে লক্ষ করলাম, এটা জ্বর পরিমাপের ইনফ্রারেড থার্মোমিটার!

আমার কপালের সামনে থেকে মিটারটা নামিয়ে চোখ–মুখ ঢাকা লোকটি বলে উঠলেন, স্যার জ্বর নাই, ৯৮ ডিগ্রি।

গলাটা পরিচিত মনে হলো। আরে এ যে আমাদের নিরাপত্তারক্ষী বিকাশ দা।

-বিকাশ দা না?

-জি স্যার, বিকাশ। চিনতে পারতাছেন না!

-না, কেমনে চিনব? আপনে তো পুরাই প্যাকেটের ভেতর ঢুকে গেছেন!

-স্যার, এটা প্যাকেট না। এইটার নাম পিপিই। আমি হইলাম স্যার ফ্রন্ট ফাইটার। করোনাযুদ্ধে সামনের সারিতে খেলতাছি। তাই এইটা পইরা আছি স্যার!

-বিকাশ দা, আপনি ফ্রন্ট ফাইটার? আমি তো জানতাম ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, ভলানটিয়ার—এরাই ফ্রন্ট ফাইটার।

-দেখেন স্যার, সারা দিন অফিসে যত লোক আসব, তাদের জ্বর মাপা, সেনিটাইজার দেওয়া—এগুলো তো সহজ কাজ না। অফিসে ঢুকতে গেলে আগে আমার পরীক্ষায় পাস করতে হইব। আমি যদি বলি জ্বর ১০০, তাইলে ন-ঢুকন!

কথা বলতে বলতে বিকাশ দা আমার জুতায় স্প্রে করলেন, তারপর হ্যান্ড স্যানিটাইজার এগিয়ে দিলেন। আমি হাত ভালো করে পরিষ্কার করে অফিসে ঢুকলাম।

বিকেলে আমাদের টাউন হল ছিল। টাউন হলে আলোচনার শেষের দিকে আমার টিম মেট ইমতিয়াজ বলল, স্যার, চট্টগ্রামে এখন নিদারুণ অক্সিজেন–সংকট। আমরা কী কিছু করতে পারি?

আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকালাম। এই ছেলেটা সব সময় আমাকে বিস্মিত করে তার মানবিক চিন্তাভাবনা দিয়ে।

আমি বললাম, তোমরা ফান্ড রেস করো। আমি ৫টি সিলিন্ডার দেব, তোমরা বাকিরা ৫টি দাও।

ইমতিয়াজ বলল, অবশ্যই স্যার, পারলে আরও বেশি দিব। আমার বাকি সহকর্মীরাও হাত উঠিয়ে বলল, আমরাও সঙ্গে আছি সবাই।

আমার কেন জানি মনোবল বেড়ে গেল। ইমতিয়াজকে বললাম চট্টগ্রামের যেসব জায়গায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করছে, ওগুলোর রেগুলেটরসহ প্রাইস নাও।

সে অফিস ছুটির আগে আগে এসে বলল স্যার, বড় সংকট! ভীষণ সংকট! কোথাও ২-৩টার বেশি নাই। দাম কোথাও একেকটা ২২-২৫ হাজার টাকা।

-বলো কি, ইমতি?

-জি স্যার! প্রাইস ডাবল হয়ে গেছে।

-ইমতি, সুযোগসন্ধানী কিছু লোকজন থাকবেই সব সময়। তবু চেষ্টা কর। অন্তত ২০টা অর্ডার করো। টাকা ব্যবস্থা হবে।

-আপনি না ১০টা বললেন স্যার।

-হ্যাঁ, বলেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে অন্তত ১০০টা কি না দরকার। করোনায় শ্বাসকষ্ট নিয়ে যারা ভুগছেন, তাদের ফ্রিতে আমরা অক্সিজেন সরবরাহ করব। অক্সিজেন নিয়ে যে কি হাহাকার চলছে!

-স্যার, টাকাপয়সা যাদের আছে, তারা করোনার ভয়ে আগেই কিনে বাসায় রেখে দিয়েছেন। অথচ এটা তাদের কাজে না–ও লাগাতে পারে। অথচ অনেক রোগী শ্বাসকষ্ট নিয়ে ছটফট করছে। একটু অক্সিজেন তাদের দিতে পারে নতুন জীবন, ইমতিয়াজ বলল।

-আমরা এই সিলিন্ডারগুলো কোনো একটা সুবিধাজনক জায়গায় স্টোর করব। তারপর তোমরা যারা ডোনেট করছ তোমাদের প্রয়োজন হলে অগ্রাধিকার হিসাবে তোমরা পাবে। আর বাকিগুলো যখন যার প্রয়োজন সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে তাদের কাছে পৌঁছে দেব আমরা।

-ব্যাপারটা দারুণ হবে স্যার।

এই প্রয়াসে যে কেউ যুক্ত হতে পারেন। ধরুন, আপনি ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটি সিলিন্ডার কিনে দিলেন। এটি আপনার কিংবা আপনার নিকটাত্মীয়ের প্রয়োজনে কাজে লাগল আর প্রয়োজন না হলে এটা যাদের দরকার, তাদের কাছে আমাদের ভলানটিয়ার টিম পৌঁছে দিল। বাসায় অক্সিজেন মজুত করার চিন্তা থেকে মনে হয় বের হয়ে আসা দরকার।

অফিস থেকে বের হওয়ার সময় নিরাপত্তারক্ষী বিকাশদা বললেন, স্যার, আপনাদের সব কথা শুনেছি। আমিও পাঁচ শ টাকা দিমু। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ!

আমি বুক ভরা আশা নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে বাসার দিকে ছুটলাম। ৬ (নফল) রোজার আজ দ্বিতীয়টি (৩১ মে) চলছে আমার। ইফতারের আগে বাসায় পৌঁছতে পারব তো?

ঠিক আজানের দুই মিনিট আগে বাসায় পৌঁছালাম। ইফতার শেষে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম। মহান আল্লাহ, সবার এই সুবিবেচনাকে যেন কবুল করেন।

*সিইও, র‌্যাঙ্কস এফসি প্রপারটি লিমিটেড। rimon@rancon.com.bd