৩৮টি প্রতিষ্ঠান একটি ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহ করে। এক মাসে তিন কোটি টাকার বেশি ময়লার বিল আসে।
ওয়ার্ড একটি। তাতে বর্জ্য সংগ্রহ করে ৩৮টি প্রতিষ্ঠান। এর ৩১টির মালিক আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পদধারী নেতারা।
ঢাকা উত্তর সিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ময়লা-বাণিজ্য ভাগাভাগি করে নিয়েছেন এসব নেতা। রাজধানীর অভিজাত দুই এলাকা গুলশান ও বনানী নিয়ে এই ওয়ার্ড গঠিত।
ওয়ার্ডবাসীর অনেকের অভিযোগ, ময়লা সংগ্রহের টাকা আদায়ে কোনো শৃঙ্খলা নেই। নেতার লোকেরা ইচ্ছেমতো ময়লার বিল নেয়। বাসাপ্রতি ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। হোটেল-রেস্তোরাঁয় তা কয়েক হাজার টাকা। এ নিয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে একাধিকবার অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ময়লা সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতি ও শ্রমিক লীগের বিভিন্ন পদে আছেন। ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের মালিকের মধ্যে ১০ জন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের, ৫ জন স্বেচ্ছাসেবক লীগের, ২ জন করে তাঁতি লীগ ও শ্রমিক লীগের এবং ১ জন করে মহিলা আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের। ১০ জন বিভিন্ন কমিটির আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্য পদে আছেন। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় দলের নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায়।
গুলশান ও বনানীর মোট হোল্ডিং, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ ও বর্জ্য সংগ্রহকারী কর্মীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে প্রতি মাসে এই ওয়ার্ডে তিন কোটি টাকার বেশি ময়লার বিল ওঠে।
ওয়ার্ডটি নিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক কর্মকর্তার মন্তব্যটাও এমন, ‘ময়লা তো ময়লা নয়, এ যেন মধু। মাছির মতো সেই মধুর পেছনে লেগেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা।’
ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগের হিসাবেই, গুলশানে ১১ হাজার ১০৭টি হোল্ডিং আর বনানীতে ৬ হাজার ৫০টি হোল্ডিং মিলে মোট ১৭ হাজার ১৫৭টি হোল্ডিং আছে। একেকটিতে গড়ে ৬টি ফ্ল্যাট ধরে প্রায় ১ লাখ ২ হাজার ৯৪২টি ফ্ল্যাট আছে। ফ্ল্যাটপ্রতি গড়ে ৩০০ টাকা হিসাবে প্রতি মাসে বিল আসে ৩ কোটি ৮ লাখ ৮২ হাজার ৬০০ টাকা।
আর গুলশান ও বনানীর রেস্তোরাঁমালিকেরা বলছেন, তাঁদের কাছ থেকে চার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত ময়লার বিল নেওয়া হয়। বাংলাদেশ হোটেল-রেস্তোরাঁ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে ওই দুই এলাকায় শতাধিক রেস্তোরাঁ আছে। গড়ে চার হাজার টাকা ধরে ১০০টি রেস্তোরাঁ থেকে মাসে চার লাখ টাকা ওঠে।
প্রতিটি ফ্ল্যাট ও হোটেল–রেস্তোরাঁর হিসাবে শুধু ১৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকেই বর্জ্য সংগ্রহকারীরা মাসে ৩ কোটি ১২ লাখ ৮২ হাজার ৬০০ টাকা নেন।
অথচ ২০০৯ সালে অবিভক্ত সিটি করপোরেশন বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহে মাসিক ফি সর্বোচ্চ ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি টাকা ময়লার বিল হিসেবে গুলশান ও বনানী এলাকায় এত দিন আদায় হয়ে আসছে।
# প্রতি বাসা থেকে আদায় করা হয় ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা। # হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে নেওয়া হয় চার থেকে আট হাজার টাকা। # বর্জ্য সংগ্রহকারী সব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কাউন্সিলরকে মাসিক চাঁদা দেয়।
আর গত ডিসেম্বরে ডিএনসিসির বোর্ড সভায় উচ্চবিত্তদের বসবাসের এলাকায় মাসে ১০০ টাকা এবং অনুন্নত এলাকায় ৫০ টাকা করে নেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এ ছাড়া একটি ওয়ার্ডে কেবল চারটি প্রতিষ্ঠানকে বর্জ্য সংগ্রহের অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টিও চূড়ান্ত হয়েছে। তবে এসব সিদ্ধান্ত এখনো কার্যকর হয়নি।
ময়লার বিল ১০০ টাকা করে ওঠানো হলেও এই ওয়ার্ডে প্রতি মাসে বিল উঠত ১ কোটি ২ লাখ ৯৪ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে এই ওয়ার্ডে বাড়তি ২ কোটি ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৪০০ টাকা আদায় করছেন বর্জ্য সংগ্রহকারীরা।
গুলশান-১–এর বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আমানত আলী বলেন, করপোরেশনকে গৃহকরের সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা কর দেওয়ার পরও আলাদা করে বর্জ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানকে ময়লার বিল দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ হোটেল-রেস্তোরাঁ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন মৃধা বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান পূর্ণিমা রেস্টুরেন্ট থেকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা নেওয়া হয়। চায়নিজ কিংবা থাই রেস্তোরাঁ থেকে আরও বেশি টাকা নেওয়া হয়।
বর্জ্য সংগ্রহে যুক্ত দলীয় পদধারী নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন কমিটির সভাপতিরা হচ্ছেন বনানী ইউনিট আওয়ামী লীগের খন্দকার ইউছুফ (আনোয়ার ট্রেডার্স), ওয়ার্ড যুবলীগের মোহাম্মদ মোস্তফা (মা এন্টারপ্রাইজ), ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের মোহাম্মদ মান্নান (মৃদুল এন্টারপ্রাইজ), বনানী ইউনিট যুবলীগের মো. ফরিদ (ফারিয়া এন্টারপ্রাইজ), গুলশান থানা তাঁতি লীগের আজিজুল হক (ভাই ভাই সমাজকল্যাণ সংঘ), গুলশান-১ ইউনিট আওয়ামী লীগের দ্বীন মোহাম্মদ (সাকের এন্টারপ্রাইজ) এবং গুলশান-২ ইউনিট স্বেচ্ছাসেবক লীগের মো. রানা (রায়হান ক্লিনিং সার্ভিস)।
বিভিন্ন কমিটির সহসভাপতিরা হলেন ঢাকা মহানগর উত্তর তাঁতি লীগের ওবায়দুল ইসলাম (মাল্টিট্রেড কনসালট্যান্ট), বনানী থানা জাতীয় শ্রমিক লীগের মো. সোলায়মান (সোলায়মান ক্লিনিং সার্ভিস), বনানী থানা মহিলা আওয়ামী লীগের মনোয়ারা মজলিশ (পারভেজ ক্লিনিং সার্ভিস), ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের হুমায়ূন কবির (বিসমিল্লাহ কন্সট্রাকশন) এবং বনানী থানা যুবলীগের গোলাম মাওলা (মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সংস্থা)।
এ ছাড়া বিভিন্ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক পদের তিনজন করে নেতা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক। এর বাইরে ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত মো. আলমগীর হোসেনের নামে প্রতিষ্ঠান চালান এই নেতার স্ত্রী শাহিদা আলম। আর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা লিটন ঘোষ দুটি প্রতিষ্ঠান—নৈতিক ও জয় ক্লিনিং সার্ভিসের মালিক। অন্য ১০ জন মালিক বিভিন্ন কমিটির আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক কিংবা সদস্য পদে আছেন।
গুলশান ৭৪ নম্বর ও ৮৬ নম্বর রাস্তায় ফ্ল্যাটপ্রতি ৪০০ টাকা নেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য মো. খোকন। খোকনের ভাষ্য, ‘ভবনমালিক ও তত্ত্বাবধায়কেরা বাসাপ্রতি ৪০০ টাকা নেন। কিন্তু আমাদের ফ্ল্যাট হিসাবে ১৫০ টাকা করে দেন।’
ওয়ার্ডটির ১৫টি প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা বলছেন, প্রতি মাসে কমিশন হিসাবে কাউন্সিলরকে টাকা দিতে হয়। এই কারণেই ময়লার বিল বেশি নিতে হয়। গুলশান থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক লিটন ঘোষের কাছে তাঁরা প্রতি মাসের কমিশনের ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা জমা দেন। বিষয়টি স্বীকার করে লিটন ঘোষ বলেন, গরিব নেতা-কর্মীদের সহায়তার জন্য টাকাটি নেওয়া হতো। তবে এই টাকা প্রায় এক বছর ধরে নেওয়া হচ্ছে না।
টাকার বিষয়ে কাউন্সিলর মফিজুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি শতভাগ সত্যও না আবার মিথ্যাও না। দলের (আওয়ামী লীগ) খরচের জন্য (মিছিল, মিটিং, সমাবেশ) এই টাকা তারাই দিত।’
করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জাকির হোসেন বলেন, দরপত্রের মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহের প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হলে নির্ধারিত ১০০ বা ৫০ টাকার বেশি নেওয়া যাবে না। নিলে নিয়োগ বাতিল করার ব্যবস্থা আছে।
ডিএনসিসির ১৯ নম্বরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের অন্যতম মূল দায়িত্বই হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। করপোরেশন নিজে বর্জ্যের কর নিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করলে মধ্যস্বত্বভোগীরা এই সুবিধা নিতে পারবে না।’