জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে, মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাংবাদিককে সাজা দেওয়ার ঘটনায় বিধিবিধান মানা হয়নি।
মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাংবাদিককে সাজা দেওয়া ও ‘নির্যাতনের’ ঘটনায় শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছেন কুড়িগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসকসহ (ডিসি) প্রশাসনের চার কর্মকর্তা। তবে যে দুজনের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল, তাঁদের তুলনামূলক কম শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। আর যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ কম ছিল, তিনি পেতে যাচ্ছেন গুরুদণ্ড।
এই কর্মকর্তারা শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছেন কুড়িগ্রামে বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে ধরে এনে সাজা দেওয়ার ঘটনায়। গত বছরের ১৩ মার্চ দিবাগত রাতে তাঁকে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এনে ভ্রাম্যমাণ আদালতে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তখন দাবি করা হয়েছিল, ‘মাদকবিরোধী অভিযানে’ আরিফুলের কাছ থেকে আধা বোতল মদ ও ১৫০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে।
সাংবাদিক আরিফুল দাবি করেছিলেন, তাঁকে সাজা দেওয়া ও নির্যাতনের কারণ তৎকালীন জেলা প্রশাসনের অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা। এ ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল।
ঘটনার পরপরই কুড়িগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন এবং দুই সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এস এম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। একই সঙ্গে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত ও শুনানি করে তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীনকে লঘুদণ্ড হিসেবে দুই বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিনের ক্ষেত্রে পদাবনতির সুপারিশ করা হয়েছে। আর এনডিসি এস এম রাহাতুল ইসলাম তিন বছর বেতন বৃদ্ধির সুবিধা হারাবেন। সবচেয়ে কঠোর শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে সেই রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করা সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমার ক্ষেত্রে। তাঁকে চাকরিচ্যুত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে নথি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায়। সেই প্রক্রিয়াটি এখন চলমান। রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে এসব ক্ষেত্রে সাধারণত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ীই শাস্তি হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনসহ কিছু প্রক্রিয়া শেষ হলেই শাস্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। রাষ্ট্রপতি চাইলে দণ্ড কমাতে বা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
সাংবাদিককে সাজা দেওয়ার ঘটনার পরপরই তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীনকে জনপ্রশাসনে ন্যস্ত করা হয়েছিল। তাঁকে কোনো পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আর ঘটনার পর তখনকার আরডিসি নাজিম উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। তাঁর মূল পদ জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। পদাবনতি হলে তিনি সহকারী সচিব হবেন। রাহাতুল ইসলাম এখন বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনারের দায়িত্বে রয়েছেন। রিন্টু বিকাশ চাকমাও এখন কোনো দায়িত্বে নেই।
* তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীনের ক্ষেত্রে দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিত ও আরডিসি নিজাম উদ্দিনের পদাবনতির সুপারিশ করা হয়েছে। * চাকরি হারাতে যাচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা। আরেক কর্মকর্তাকেও দণ্ড। * রাষ্ট্রপতির অনুমোদনসহ কিছু প্রক্রিয়া শেষ হলেই শাস্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্তে উঠে এসেছে, সেদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকালে প্রচলিত বিধিবিধান মানা হয়নি।
সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে নির্যাতন করার ঘটনায় মূল দায়ী ব্যক্তি সুলতানা পারভীন ও নাজিম উদ্দিন। তাঁদের নামমাত্র শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। রিন্টু বিকাশ চাকমাকে বানানো হচ্ছে ‘বলির পাঁঠা’। তিনি বলেন, তাঁর জানামতে ঘটনার রাতে রিন্টু বিকাশ চাকমা দৃশ্যমান কোনো অপরাধ করেননি, শুধু বিচারিক নথিতে সই করেছিলেন। সব নির্দেশনা দিয়েছিলেন নাজিম উদ্দিন এবং তাঁর কথায় স্পষ্ট ছিল যে ডিসির নির্দেশে এসব করছেন।
আরিফুল আরও উল্লেখ করেন, এই ঘটনায় তিনি থানায় মামলা করেছেন। আশা করছেন আদালতেই ন্যায়বিচার পাবেন।
রিন্টু বিকাশ চাকমার বিষয়ে গঠন করা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত বোর্ডের প্রতিবেদনেও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় নাজিমউদ্দিন ও এস এম রাহাতুল ইসলামের এখতিয়ারবহির্ভূত ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। নাজিমউদ্দিন ও রাহাতুল এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালতে উপস্থিত হয়ে কীভাবে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন, তারও বিবরণ রয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
তদন্ত বোর্ডের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রিন্টু বিকাশ চাকমা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, তিনি আরডিসি নাজিম উদ্দিনের প্রচণ্ড চাপাচাপিতে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাজা পরোয়ানায় সই করতে বাধ্য হন। এ জন্য তিনি নবীন কর্মকর্তা হিসেবে অনুকম্পা প্রার্থনা করেন।
রিন্টু বিকাশ চাকমার দায় কেন বেশি তা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ভাষ্যমতে ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ শব্দটি দিয়ে কেবল একজন মনোনীত ব্যক্তিকে না বুঝিয়ে আদালতকে বোঝায়, যেখানে ন্যায়বিচার পরিচালনা করা হয়। সুতরাং রিন্টু বিকাশ চাকমা দায় এড়াতে পারেন না। তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকালে প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান উপেক্ষা করে এবং কর্তব্যে চরম অবহেলা করে অসদাচরণ করেছেন।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তদন্তের ভিত্তিতেই এসব ব্যবস্থা নেয়। এখন শাস্তির পর কেউ অসন্তুষ্ট হলে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে প্রতিকার চাইতে পারবেন।