আষাঢ়ের দুপুর। মেঘের আড়ালে সূর্য লুকালেও ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস জনজীবন। প্রকৃতির এমন রূপকে অগ্রাহ্য করেই হুইলচেয়ারে বসা এক ব্যক্তিকে ঠেলে নিয়ে ঠাকুরগাঁও শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে এক শিশু। আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেলে কায়দা করে হুইলচেয়ারটি থামিয়ে মেয়েটি জানাল, তার নাম রোকাইয়া আক্তার। আর হুইলচেয়ারে বসা মানুষটি তার বাবা এনামুল হক।
প্রতিবন্ধী বাবার ওষুধ আর সংসারের খরচ জোগাড় করতে বাবাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে আর্থিক সাহায্যের জন্য ঠাকুরগাঁও শহরে আসে রোকাইয়া। বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ীদের কাছেই রোকাইয়া আর তার বাবা চেনামুখ। কারণ, বছর তিনেক ধরে সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এ কাজ করে আসছে মেয়েটি।
রোকাইয়াদের বাড়ি সদর উপজেলার চিলারং গ্রামে। সে চিলারং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তবে করোনার কারণে এখন প্রায় প্রতিদিনই শহরে আসে বাবা–মেয়ে। রোকাইয়া বলে, ‘আগে তো সপ্তাহে পাঁচ দিন স্কুলে যেতাম। আর বৃহস্পতিবার স্কুলে না গিয়ে সকালে বাবাকে নিয়ে শহরে চলে আসতাম। এখন করোনার জন্য তো স্কুল বন্ধ, তাই এখন সাত দিনই আসি।’
অসুস্থতার কারণে এনামুলের কথা স্পষ্ট নয়। তাঁর কথা বুঝতে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়। এনামুল জানান, পারিবারিক কোন্দলের জেরে ছোটবেলায় কাঁধে আঘাত পান। চিকিৎসা নিয়ে তখন সেরে উঠলেও মাঝেমধ্যেই কাঁধের আঘাত ভোগাত তাঁকে।
বছর পনেরো আগে বিয়ে করেন এনামুল। বিয়ের তিন বছর পর ঘরে আসে রোকাইয়া। মেয়ের জন্মের কিছুদিন পর থেকেই এনামুলের শারীরিক সমস্যা বাড়তে থাকে। একসময় তাঁর চলাফেরা-কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। রোকাইয়ার বয়স যখন পাঁচ, সংসারের অভাব–অনটন সইতে না পেরে তখন সংসার ফেলে চলে যান এনামুলের স্ত্রী।
এনামুলের কষ্ট দেখে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এনামুলকে একটি প্রতিবন্ধী কার্ড করে দিয়েছেন। চলাফেরার জন্য একটি হুইলচেয়ারেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তাঁরা। তবে অন্যের সাহায্যের ওপর নিভ৴র করেই চলতে হয় বলে অভাব তাঁদের পিছু ছাড়ে না। বাবাকে ঠেলে নিয়ে তাই রোকাইয়ার পথচলা থামে না। হুইলচেয়ারটি ঠেলে নিতে কষ্ট হয় না? এমন প্রশ্ন শুনে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে রোকাইয়ার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর, ‘কই কষ্ট! একটু ঠেলা দিলেই তো চেয়ারটা একা একাই চলে।’
চিলারং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা সুলতানা বলেন, ‘বাবার জন্য রোকাইয়া কষ্ট করে চলেছে। তবে ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কষ্ট হয়।’ সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে রোকাইয়ার বাবার কপালেও চিন্তার ভাঁজ। এনামুল হক বলেন, ‘করোনায় খুব কষ্টে দিন কাটছে। নিরুপায় হয়েই মেয়েটাকে নিয়ে এখন প্রতিদিন শহরে চলে আসি। সপ্তাহে ৬০০-৭০০ টাকা সাহায্য আসে। মেয়েটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে খুব খারাপ লাগে। বড় হলে তো সে আর এটা (হুইলচেয়ার ঠেলা) করতে পারবে না।’ তাই পড়াশোনার পাশাপাশি সুযোগ পেলে মেয়েকে হাতের কাজ শেখাতে চান তিনি।
সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অরুণাংশু দত্ত বলেন, একজন শিশুকে সাহায্যের জন্য বাবাকে হুইলচেয়ারে নিয়ে শহরের দোকানে দোকানে ঘুরতে হচ্ছে, এটা খুবই দুঃখজনক। খোঁজখবর নিয়ে বাবা-মেয়ের জন্য বিকল্প কিছু ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।