নুসরাতের পড়ার টেবিলে মাথা রেখে কাঁদলেন মা

নুসরাতের পড়ার টেবিল। এই টেবিলে মাথা রেখে মেয়ের স্পর্শ পেতে চাইলেন মা শিরিনা আক্তার। রায় ঘোষণার পর গতকাল বিকেলে সোনাগাজীর উত্তর চর চান্দিয়া গ্রামের বাড়িতে। ছবি: জুয়েল শীল
নুসরাতের পড়ার টেবিল। এই টেবিলে মাথা রেখে মেয়ের স্পর্শ পেতে চাইলেন মা শিরিনা আক্তার। রায় ঘোষণার পর গতকাল বিকেলে সোনাগাজীর উত্তর চর চান্দিয়া গ্রামের বাড়িতে।  ছবি: জুয়েল শীল

সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছিলেন নুসরাত জাহানের মা শিরিনা আক্তার। গতকাল বৃহস্পতিবার এ মামলার রায়ে সব আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন নুসরাতের মা। সরাসরি কৃতজ্ঞতা জানাতে পরিবারের সব সদস্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী তিনি।

গতকাল বিকেলে সোনাগাজীর উত্তর চর চান্দিয়ার গ্রামের বাড়িতে এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন শিরিনা আক্তার। এ সময় বাড়ির আঙিনায় পুলিশি পাহারা ছিল। স্বজন ও প্রতিবেশীরা দলে দলে বাড়িতে গিয়ে সহানুভূতি জানাচ্ছিলেন। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারাও ওই বাড়িতে ছুটে যান। নুসরাতের বাবা-মা ও ভাইদের খোঁজ নেন। কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, পরিবারের সদস্যদের কাছে জানতে চান পুলিশ কর্মকর্তারা।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও নুসরাতের মা অজানা আতঙ্কের কথাও বলেছেন। শিরিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামির লোকজন বাইরে আছে। তারা সংগঠিত। যেকোনো সময় তারা ভয়ংকর কিছু করতে পারে।’

শিরিনা আক্তার বলেন, ‘এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছি। আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সব আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর দেখে যেতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টায় আসামিরা ধরা পড়েছে। বিচারও আমরা পেয়েছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করে তাঁকে ধন্যবাদ দিতে চাই। তাঁকে অনুরোধ করব, উচ্চ আদালতে আপিল যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। রাষ্ট্রপক্ষ এ পর্যন্ত আমাদের যেভাবে সহযোগিতা করেছে, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সে সহযোগিতা আমরা চাই।’

গতকাল বিকেলে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শিরিনা আক্তার ছুটে যান নুসরাতের পড়ার ঘরে। সেখানে পড়ার টেবিলে মাথা নুয়ে কেঁদে দেন। শিরিনা আক্তার বলেন, ‘মেয়ের ঘরে গিয়ে টেবিলে বই-খাতার দিকে তাকালে নিজেকে সামলে রাখতে পারি না। ঘুমের মধ্যেও শুনতে পাই, নুসরাত মা মা করে ডাকছে। ঘুম ভেঙে গেলে আঁতকে উঠি। তখন আর ঘুম আসে না।’

নুসরাতের বাবা এ কে এম মুসা মিয়া নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে প্রশাসনের কাছে ধারাবাহিক সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নুসরাতকে হত্যার পর পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের ভূমিকা আমরা কখনো ভুলব না। প্রশাসনের পাশাপাশি সাংবাদিকেরাও আমাদের দিকে নজর রাখবেন বলে আমরা আশাবাদী।’

গতকাল এজলাস কক্ষে রায় ঘোষণার পর বিচারক মামুনুর রশিদ খাসকামরায় চলে গেলে আসামিরা অশ্লীল ভাষায় সাংবাদিক, পুলিশ ও বাদীর আইনজীবীদের গালিগালাজ করেন। চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার বাদী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান (নোমান)। তাঁকেও এজলাস কক্ষে হুমকি দেন কয়েকজন আসামি। এ সময় মাহমুদুল হাসান দ্রুত এজলাস কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।

মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রায় ঘোষণার পর আসামিরা আমাকে প্রকাশ্যে সবার সামনে গালিগালাজ করে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। আমরা সব সময় বলে আসছি, ওরা সুযোগ পেলে আমাদেরও ক্ষতি করবে। ওরা আমার বোনকে যন্ত্রণা দিয়ে মেরেছে। আমাদেরও তারা মেরে ফেলতে পারে। আমরা সব আসামির রায় দ্রুত কার্যকর দেখতে চাই।’ তিনি বলেন, ফাঁসি কার্যকর হলে এ ধরনের নৃশংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।

নুসরাতদের প্রতিবেশী মোশাররফ হোসেন (৪০) সোনাগাজী বাজারে ব্যবসা করেন। গতকাল রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে যান নুসরাতদের বাড়ি। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, এ রায় কার্যকর হলে সোনাগাজীবাসী কলঙ্কমুক্ত হবে। আর কেউ এ রকম অপরাধের কথা চিন্তাও করবে না।