>বিশেষজ্ঞ মত: বিশেষ ধারা রাখা ঠিক নয়। এতে বাল্যবিবাহ বৈধতা পেতে পারে
মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরই থাকছে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে যেকোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে হতে পারবে। আইন চূড়ান্ত হওয়ার পর এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিধি তৈরি করবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’-এর যে খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে, তাতে বিশেষ ক্ষেত্রে বিয়ের প্রসঙ্গটি ১৯ ধারায় উল্লেখ করা হয়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে ১৮-এর নিচে কত বছর বয়সে বিয়ে হতে পারে, আইনে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশটি পুনর্বিন্যাস ও বাংলায় রূপান্তর করে ওই আইনে বিভিন্ন অপরাধের আওতা ও সাজার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও নারী নেত্রীরা আইনে বিশেষ বিধান রাখার সমালোচনা করে এর অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা মনে করেন, আইনের ফাঁক গলে বাল্যবিবাহ বৈধতা পেতে পারে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে এই আশঙ্কাকে অমূলক বলা হয়েছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি গতকাল টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতেই পারে। কোনো ঘটনা ঘটলে আদালত ও বাবা-মায়ের সম্মতি থাকলে তবেই বিয়ে হতে পারে। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করলেও কিশোর-কিশোরীদের প্রেম বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটি নয়। কোনো কিশোরী পরিস্থিতির শিকার হয়ে গর্ভবতী হলে তখন তার ভবিষ্যৎ কী হবে? অভিভাবকহীন প্রতিবন্ধী কিশোরীর থাকার জায়গা না থাকলে ১৮ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা না করে মঙ্গলজনক মনে হলে বিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রগুলো আইনের বিধিতে সুনির্দিষ্ট করা থাকবে বলে জানান তিনি।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনের খসড়ায় বিশেষ ধারা যুক্ত করায় আমি হতাশ। আমি বিক্ষুব্ধ হয়েছি। নারীর ক্ষমতায়নে দেশ সামনে এগোচ্ছে বলে আমরা দাবি করছি, এ বিষয়টির সঙ্গে বিশেষ ধারা সংগতিপূর্ণ নয়।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটিসহ নীতিনির্ধারকেরা আশ্বস্ত করেছিলেন, আইনের খসড়া থেকে বিশেষ ধারাটি বাদ যাবে। এখন প্রত্যাশা, জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের পর প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যরা বিষয়টি আবার বিবেচনা করবেন।
অপব্যবহারের আশঙ্কা
সামগ্রিকভাবে আইনটিকে স্বাগত জানানো হলেও এর বিশেষ ধারাটির অপব্যবহারের আশঙ্কা করা হচ্ছে। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের বয়স ১৮ বছর রাখার সিদ্ধান্ত সঠিক। তবে আইনে এমন কোনো জায়গা রাখা ঠিক হবে না, যাতে সুযোগসন্ধানীরা কোনো
সুযোগ পায় এবং সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিশোরীদের বিয়ের আয়োজন করতে পারে।
আইনের ১৯ ধারায় উল্লেখিত বিশেষ বিধানের ব্যাখ্যা সম্পর্কে সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রথম আলোর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, বিশেষ প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশ ও মা-বাবার সম্মতিতে অনুষ্ঠিত বিয়ে বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেন, অবিবাহিত মা বা অন্য কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বেলায় এই বিধান প্রযোজ্য হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মন্ত্রিসভার বৈঠকের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ব্রিফিংয়ে তুলে ধরেন।
এ বিষয়ে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসি সুলতানা মনে করেন, ‘আইনের বিশেষ ধারাটির অপব্যবহার হবে। আদালত ও বাবা-মায়ের সম্মতির কথা বলা থাকলেও আমাদের দেশে যাঁরা মেয়ের বাল্যবিবাহ দেন, তাঁদের মধ্যে কতজনের আদালত পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা আছে? আইনের নজরদারিই বা কতটুকু হয়?’ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আইনের ফাঁকফোকর ঠিকই বের হবে। আর আইনে বিশেষ ধারা যুক্ত না করলে তাতে কোনো ক্ষতি ছিল না।
বাল্যবিবাহের সাজা: বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত বিষয়ে কেউ মিথ্যা অভিযোগ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৩০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়ে বাল্যবিবাহ করলে তাদের ১৫ দিনের আটকাদেশ ও অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষ অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে বিয়ে করলে দুই বছর কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
মা-বাবা আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। তবে কমপক্ষে ছয় মাসের সাজা দিতে হবে। জরিমানার টাকা শোধ না করলে তিন মাস কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বিয়ে সম্পাদন বা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কাজি, রেজিস্ট্রার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আইন না মানলে দুই বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তি দেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে জরিমানার টাকা থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যাবে।
ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত মামলার বিচার অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধের মতোই হবে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত বিচার করতে পারবেন। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী, আদালত নিজ উদ্যোগে বা কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বাল্যবিবাহ থামিয়ে দিতে পারবেন। বাল্যবিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তা পুনর্বিবেচনা করতে পারবেন আদালত। বাল্যবিবাহ বন্ধে আদালতের নিষেধাজ্ঞা না মানলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা মাধ্যমিক পরীক্ষার সনদ বা সমমানের পরীক্ষার সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ, পাসপোর্ট-এগুলোর যেকোনো একটি বিয়ের বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য হবে।
আরও পড়ুন: