দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম। কলেজের প্রধান ফটকের বিপরীতে একটি ছাত্রাবাসে (মেস) থাকেন। গত রোববার সকাল নয়টায় কলেজ মোড় এলাকায় একটি দোকানে চায়ের মধ্যে বিস্কুট চুবিয়ে মুখে পুরছিলেন। দুই পায়ের ফাঁকে রাখা বাজারের থলে।
আলাপচারিতার একপর্যায়ে জানালেন, মেসে তাঁরা ২৫ জন সদস্য। অধিকাংশই সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। হাজী দানেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও আছেন কয়েকজন। রুটিনমাফিক মাসে এক দিন বাজার করার দায়িত্ব বর্তায় তাঁর কাঁধে। আজকের (রোববার) বাজারের দায়িত্ব তাঁর। সকালে ডাল আর আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে বাজারে বেরিয়েছেন। বাজার শেষে কলেজ মোড়ে চা-বিস্কুট খাচ্ছেন। এরপর একেবারে দুপুরে ভাত খাবেন।
আশরাফুল বলেন, মাস তিনেক আগেও মেসে তিন বেলা খাবার বাবদ ২৫ টাকা হলেই চলত (চাল বাদে)। আর এখন তিন বেলা খাবারের জন্য গুনতে হচ্ছে ৩০ টাকা। টাকা বাড়লেও কমেছে তাঁদের খাবারের মান ও পরিমাণ। আগে সপ্তাহের পাঁচ দিন দুপুরে আমিষ খাওয়া পড়ত। সঙ্গে এক পদের সবজি থাকত। রাতে সবজির সঙ্গে ডিমভাজা ও ভর্তা থাকত। এখন দুপুরে একটা সবজি কিংবা আলুর ডালের সঙ্গে ডিমভাজার বেশি কিছু চিন্তা করা যায় না। যেদিন যাঁর বাজারের দায়িত্ব থাকে, নির্দিষ্ট টাকার মধ্যে তাঁকে বাজার করতে হয়। এর বেশি হলে বাজারের দায়িত্বে থাকা মেস সদস্যকে পকেট থেকে ভর্তুকি দিতে হয়। মেসে সম্প্রতি এমন নিয়ম চালু করা হয়েছে।
গত রোববার ২৫ সদস্যের মধ্যে ১৮ জনের জন্য মেসে রান্না হয়েছে। এই ১৮ জনের জন্য আশরাফুল সদাই করেছেন শহরের সুইহারি বাজার থেকে। দুপুরে খাবারের তালিকায় রেখেছেন ব্রয়লার মুরগি ভুনা, সঙ্গে আলু আর ঝিঙার সবজি; রাতে করলা ও আলুভাজি, সঙ্গে মসুর ডাল। পরের দিন সকালের খাবারে মসুর ডালের সঙ্গে আলুভর্তা। জনপ্রতি নির্ধারিত ৩০ টাকা হিসাবে ১৮ জনের জন্য ৫৪০ টাকার বাজার করেছেন। এর মধ্যে ব্রয়লার মুরগি ১৭০ টাকা, সয়াবিন তেল ১০০ টাকার, ২৫ টাকার ডাল, পেঁয়াজ-মরিচ ৪০ টাকা, আলু ৬০ টাকা, আদা-রসুন কিনেছেন ২০ টাকার, মসলা ২০ টাকার এবং সবজি (করলা, ঝিঙা) কিনেছেন ১০৫ টাকার।
আশরাফুল জানান, সামর্থ্যবান কেউ কেউ দুপুর বা রাতের খাবারের সঙ্গে বাড়তি ডিম ভেজে নিতেন গৃহকর্মীর কাছ থেকে। জ্বালানি খরচ ও সয়াবিন তেলের দাম বাড়ায় মেসে এখন বাড়তি ডিম কিংবা মাছভাজা বন্ধ আছে। মেসে এ নিয়ে মাসিক সভায় বাগ্বিতণ্ডা পর্যন্ত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তেল খরচ বেশি হয়, এমন পদের রান্নাও কমিয়েছেন তাঁরা।
আশরাফুলের বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার পাল্টাপুর এলাকায়। বাবা দরজির কাজ করেন। তিন ভাই–বোনের মধ্যে তিনি বড়। মেজ ভাই উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। একমাত্র বোন তৃতীয় শ্রেণিতে। আশরাফুল বলেন, প্রতি মাসে মেসভাড়া ৫০০ টাকা, খাবার বাবদ ৯০০-১০০০ টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খরচ, পত্রিকার বিল, মসজিদের চাঁদা, ওয়াই–ফাই বিল, গৃহকর্মীর মাসোহারা বাবদ ৫৭০ টাকা খরচ তাঁর। রোজগার কমে যাওয়ায় পাঁচ মাস ধরে দেড় হাজার টাকার জায়গায় বাবা এক হাজার টাকা পাঠাচ্ছেন তাঁকে। ঈদের আগে মেসে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। চাঁদা ছিল ১০০ টাকা। সেই টাকাও এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করতে হয়েছে তাঁকে। অবশ্য ঈদের পরে ২ হাজার টাকার একটি টিউশনি পাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে আশরাফুলের মধ্যে।
কথা বলতে বলতেই এই প্রতিবেদক গিয়ে হাজির হন আশরাফুলের মেসে। গৃহকর্মী রান্না শেষ করেছেন মাত্র। বললেন, এই মেসে প্রায় এক মাস পর গরুর মাংস রান্না হয়েছে গত শুক্রবার। মেসের সদস্য মো. সালাম বলেন, আগে মাসে দুবার ফিস্ট (গরুর মাংস, বাদামভর্তা ও ডালসমেত বিশেষ খাবার) হতো, এখন একবার হয়।
সালাম জানালেন, চার মাস আগে কেনা ২৪০ টাকার প্রতি মণ জ্বালানি এখন ৩৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ৫০০ টাকা কেজির গরুর মাংস ৭০০ টাকা, ১৩০ টাকার সয়াবিন ২১০ টাকা। বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম। ‘ছাত্র মানুষ, আমাদেরকে হিসাব করে বাড়ি থেকে টাকা নিতে হয়’, বললেন সালাম।
দিনাজপুর শহরের ফুলবাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঁশেরহাট পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার পথ। এর মধ্যে পড়েছে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর সরকারি কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সরকারি সিটি কলেজ এবং সরকারি মহিলা কলেজ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবাসন সংকুলান না থাকায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী মেসে থেকে পড়াশোনা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে অধিকাংশ মেসে শিক্ষার্থীদের খাবারের মান প্রায় একই রকম।
এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৪৯ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১৯টি আবাসিক ছাত্রাবাসে ৫ হাজার ১৪৪ জন শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা আছে। আর বাকিদের থাকতে হয় প্রতিষ্ঠানসংলগ্ন বিভিন্ন মেসে। মেসমালিক সমিতি বলছে, প্রায় দেড় হাজারের বেশি মেসে ২০-২২ হাজার শিক্ষার্থী থাকেন।
দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ দিন সকালে ক্লাস থাকে। সারা দিন পড়াশোনার চাপ। মেসের নির্ধারিত খাবার ছাড়া বাড়তি ডিম-দুধ কিংবা ফলমূল খাওয়া হয় না। বাবার আয়রোজগারও কম। প্রতি মাসে থাকা–খাওয়া বাবদ দুই হাজার টাকা দিতেন। গত মাস থেকে ৫০০ টাকা বাড়িয়েছেন। তাতেও কুলাচ্ছে না তাঁর। বাবার অবস্থা দেখে বাড়তি টাকা চাইতেও বিবেকে বাধে বলে জানালেন রাফিউল।