‘সকালবেলা মায়ের হাতের ভাত খেয়ে কলেজে যেতাম। কলেজে দুটি শিঙাড়া খেয়ে সারা দিন কাটাতে হতো। সবশেষে রাতে বাসায় ফিরে আবার ভাত। সেই দিনের কথা ভাবলেও অবাক হয়ে যাই।’
মায়ের আদরে স্নেহধন্য সেই মানুষটি আজ কোটিপতি। এমনি এমনি নয়, ব্যাংক থেকে ঋণ করেও নয়, মেধা খাটিয়ে। এটাই তাঁর পুঁজি। সঙ্গে যোগ হয়েছে উদ্যম আর নিরন্তর চেষ্টা। এই দুইয়ের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি খামার। একই সঙ্গে চলে কৃষিকাজ। কাজের যোগফল মিলিয়ে প্রতিবছর মুনাফা করছেন ৩৬ লাখ টাকা।
এই কোটিপতির নাম সাহিদুল ইসলাম। ডাক নাম সাঈদ। বয়স কেবল ৪০ ছুঁয়েছে। লেখাপড়া শেষে চাকরি নয়, নিজ উদ্যোগে সাহিদুলের কিছু করার স্বপ্ন গাঁথা হয় রাজধানী ঢাকায় ছাত্রজীবনে।
১৯৭৮ সালের ৮ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মশুরাকান্দা গ্রামে সাহিদুলের জন্ম। গ্রামটি সোনারগাঁয়ের পানাম নগরের খুব কাছে। বাবা জহিরুল ইসলাম ও মা মনোয়ারা বেগমের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সাহিদুল চতুর্থ। বাবা ছিলেন মশুরাকান্দার একটি মসজিদের ইমাম। তাঁর বাবার সংসার চালানোর সম্বল ছিল মাত্র ১৬ কাঠা জমি। তাই ছোটবেলা থেকে বেশ কষ্ট করেই পড়াশোনা করতে হতো তাঁকে। সে সময় মশুরাকান্দা গ্রামে পাকা রাস্তা ছিল না বললেই চলে। মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হতো সাহিদুলকে। স্টার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকার সিটি কলেজে। ১৯৯৬ সালে সিটি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে। ঢাকায় থাকার সময়ই জীবনের বাঁক ঘুরে যায় সাহিদুলের। সে কথাই শনিবার নিজের গ্রামের বাড়িতে বসে এই প্রতিবেদককে জানান তিনি।
টিউশনি করে টাকা জমানো শুরু
সাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কলেজে পড়ার সময় প্রতিদিন বাড়ি থেকে মোগরাপাড়ায় হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে আসতে হতো। দুবার বাস বদল করে প্রায় আড়াই ঘণ্টায় সিটি কলেজে যেতে হতো। ইউনিভার্সিটিতে হলে থাকিনি। কারণ হলে থাকার জন্য রাজনীতিতে জড়াতে হতো। তাই মেসে থাকতাম। কিন্তু মেসের বাড়িওয়ালাদের আচরণে খুব কষ্ট হতো। সেই ক্ষোভ থেকে প্রতিজ্ঞা করি, ঢাকায় একটি বাড়ি আমি কিনবই। তবে চাকরি করে নয়, ব্যবসা করে বাড়ি করব।’
নিজের ইচ্ছায় টাকা জমানো শুরু করেন। অসচ্ছল পরিবারে অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ নেই। তাই উপার্জনের পথ হিসেবে বেছে নেন প্রাইভেট টিউশন। সাহিদুল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রচুর টিউশনি করেছি। নিজের জন্য খুব কম টাকাই খরচ করেছি। কিন্তু টাকা জমাতাম। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় জমানো টাকা দিয়ে ২০০২ সালে ১০টি গরু কিনেছিলাম। আমাদের এলাকাটি কৃষিপ্রধান। স্থানীয় লোকজনের কাছে গরুগুলো বর্গা দিই। শর্ত ছিল লালনপালন করে ঈদুল আজহার সময় বিক্রি করা হবে। লাভের তিন ভাগের দুই ভাগ কৃষকের। বাকি এক ভাগ আমার। এভাবে বেশ কিছু টাকা আয় করি।’
টিউশনি আর গরু বিক্রির টাকায় ৬ শতাংশ জমি কেনেন সাহিদুল। তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালে অনার্স পাস করে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। ২০১০ সাল পর্যন্ত সেখানে চাকরি করি। যখন চাকরি ছেড়ে দিই, তখন আমার বেতন ছিল ৭০ হাজার টাকা। বেতনের টাকার বড় অংশও আমি সঞ্চয় করি। এই টাকায় গ্রামে বাবার ১৬ কাঠা জায়গায় ১৪টি গরু কিনে ছোট একটি খামার করি। ২০১১ সালে কোরবানির ঈদের শেষ দিকে হাটে গরুর বেশ দাম ছিল। সেই বছর কিছু লাভ হয়। পরের বছর আমার ৬ শতাংশ জমি বিক্রি করি সাত লাখ টাকায়। আমার পুঁজি আরও বেড়ে যায়। এভাবে প্রতিবছর গরুর সংখ্যা বাড়াতে থাকি।’
ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে সাহিদুলের
২০১৪ সাল থেকে ঈদের সময় ভারতীয় গরু আসা কমে যায়। সীমান্ত থেকে গরু আসা কমে যাওয়ায় সাহিদুল ইসলামের ভাগ্যের চাকা আরও দ্রুত ঘুরতে থাকে। তিনি জানান, ১৬ কাঠা পৈতৃক জমির পাশে তিন বিঘা জমি কিনে ফেলেন ওই সময়। সেখানে প্রায় এক শ গরু লালন-পালন করা যায়। কিন্তু শুধু গরু কিনলে চলবে না। এটি সঠিকভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লালন-পালন করা দরকার। এ জন্য গবাদিপশুর প্রচুর খাবার প্রয়োজন। গম-ভুসির দাম বেশি। পড়াশোনা করে, ইন্টারনেট ঘেঁটে ভুট্টার চাষ করা শুরু করেন। হাইব্রিড ভুট্টার চাষ করেন। এই হাইব্রিড ভুট্টা দিয়ে কর্ন সাইলেজ (গরু-ছাগলের খাদ্য) তৈরি করা হয় তাঁর খামারে।
কর্ন সাইলেজ দিয়ে নিজের গরুর খাদ্যের চাহিদা মেটান সাহিদুল ইসলাম। এখন তিনি বাণিজ্যিকভাবে কর্ন সাইলেজ উৎপাদন করে বিক্রি করছেন। সাহিদুল বলেন, প্রতিবছর ৭০টিরও বেশি গরু লালন-পালন করেন তিনি। ঈদুল আজহার প্রায় আট মাস আগে থেকে গরু সংগ্রহ করেন। ঈদ পর্যন্ত এসব গরু কিনতে ও পালন করতে ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়। এই গরুগুলোকে খাবার হিসেবে নিজের জমির থেকে উৎপাদিত কর্ন সাইলেজ দেওয়া হয়। আবার ভুট্টা উৎপাদনে জমির সার হিসেবে এসব গরুর বর্জ্য ব্যবহার করেন। সবকিছু রিসাইক্লিং করা হয়। এ জন্য লাভের অঙ্কও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
খামারিদের জন্য সাহিদুলের পরামর্শ হচ্ছে, খামারের কোনো খালি অংশ যেন ফেলে রাখা না হয়। পাঁচ কাঠা জমির ওপর খামার হলেও যে অংশটুকু খালি থাকে তাতে ওই খামারের গরুর জন্য হাইব্রিড ঘাসের চাষ সহজে করা যায়। জায়গা বেশি খালি থাকলে গরুর জন্য হাইব্রিড ভুট্টা তৈরি করা যায়। বছর শেষে এ থেকেও বড় অঙ্কের লাভ করা সম্ভব।
ভুট্টার পাশাপাশি হে নামের গাছ উৎপাদন করছেন সাহিদুল। কর্ন সাইলেজ ও হে খাওয়ালে গরু দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মাংসের গুণগত মানও ভালো থাকে। তিনি বলেন, ‘কর্ন সাইলেজ ও হে খাওয়ালে দ্রুত হজম করতে পারে গরু-ছাগল। তাতে এদের শারীরিক গড়ন দ্রুত বাড়ে। মাংসে চর্বিও কম হয়। এই মাংস খেতে সুস্বাদু হয়।’
বছরে মুনাফা ৩৬ লাখ টাকা
আট বছর ধরে খামারে গরু লালন-পালন করে মাত্র একবার লোকসানের মুখে পড়েছিলেন সাহিদুল। তবে সেটি খুব কম ছিল বলে জানান। তিনি বলেন, ২০১২ সালে দেড় লাখ টাকা লোকসান হয়। তবে ২০১৫ সাল থেকে ৩০ লাখ টাকার বেশি লাভ করে আসছেন। সে সময় ২৫ বিঘা জমি লিজ নিয়েছিলেন। এই জমিতে হাইব্রিড ভুট্টার চাষ করেন। প্রতিবছর দুবার এই ভুট্টার চাষ হয়। বৃষ্টি কম হলে তিনবারও ফসল পাওয়া যায়। এই হাইব্রিড ভুট্টা থেকে কর্ন সাইলেজ পাওয়া যায়। ভুট্টাসহ গাছ কেটে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। পরে সংরক্ষণ করে কর্ন সাইলেজ তৈরি হয়। প্রতি কেজি কর্ন সাইলেজ উৎপাদনে তিন টাকা খরচ হয়। বিক্রি করেন ছয় টাকা দরে। নিজের গরুর চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর ৪০০ টন কর্ন সাইলেজ দেশের বিভিন্ন খামারির কাছে বিক্রি করেন তিনি। এবার তাঁর লাভ হয়েছে ১২ লাখ টাকা।
লাভের আরও হিসাবের কথাও জানান সাহিদুল ইসলাম। বলেন, ‘আগস্ট মাসে কোরবানির ঈদের সময় ৭০টি গরু আমার খামার থেকে বিক্রি করে ১৫ লাখ টাকা মুনাফা করেছি। ২০১৭ সালেও লাভের পরিমাণ একই ছিল। এ ছাড়া প্রতি মাসে ১৫টি গরু জবাই করা হয় আমার নিজস্ব কসাইখানায়। এই মাংস বিভিন্ন সুপার শপে সরবরাহ করছি। এভাবে আরও ৭ লাখ টাকা লাভ হয়। সব মিলিয়ে ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর খামার থেকে ৩৪ লাখ টাকা লাভ হয়েছে আমার। লাভের টাকায় একটি লিচুর বাগান করেছি। লিচু বিক্রি করে দুই লাখ টাকা লাভ হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন বছরে লাভ হচ্ছে ৩৬ লাখ টাকা।’
খামারিদের কাছে সাহিদুল ‘রোল মডেল’
নিজের সাফল্যকীর্তি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সাহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, খামারিদের পরামর্শ দিতে প্রতি মাসে দেশের একটি করে জেলায় যান তিনি। খামারিদের সঙ্গে কথা বলেন। কীভাবে তিনি লাভ করছেন তা অন্য খামারিদের কাছে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘অনেকে আমার কাছে আসছেন। আমি পরামর্শ দিচ্ছি। এর জন্য কোনো টাকা নিই না। আমার মনে হয়, এভাবে চললে অল্প কয়েক বছর পর বাংলাদেশ গরুর মাংস রপ্তানি করতে পারবে। তাই আমি ভবিষ্যৎ ভাবনা নতুন করে শুরু করেছি। সেটি হলো, নিজের খামারে গরুর প্রজনন কাজ শুরু করব। এ জন্য ব্রাহমা ও শাহিওয়াল জাতের বাছুরকে বেছে নিয়েছি। এই জাতের গরু দ্রুত বড় হয়। প্রচুর মাংস পাওয়া যায়।’
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, ‘খামারিদের প্রধান খরচ হয় খাদ্যে। ৭০ শতাংশ খরচই হয় গরুর খাবারের জন্য। সাহিদুল খাবারের খরচ কমিয়ে ফেলার পদ্ধতি বের করেছেন। আমাদের সংগঠনে সাড়ে ছয় হাজার খামারি আছেন। ফেসবুকেও অসংখ্য অনুসারী রয়েছেন। সেই সব খামারির কাছে সাহিদুল রোল মডেল।’
যে স্বপ্ন নিয়ে কিছু করার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন সাহিদুল, সেই স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। ঢাকায় এখন তাঁর বাড়ি আছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তিন কাঠা জমির ওপর দোতলা বাড়ি করেছেন। স্ত্রী কামরুন্নাহার, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সাহিদুলের সংসার। দুই মেয়ে সাদিয়া ইসলাম (৯) ভিকারুননিসা নূন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে ও নাদিয়া ইসলাম (৬) একই স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে মেহমেদ ইসলামের বয়স সাড়ে তিন বছর। বাবা এখন বেঁচে নেই। মা মনোয়ারা বেগম আছেন ভাইবোনের জন্য বৃক্ষছায়া হয়ে।