কোন পথে রেলওয়ে—৩

মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায় রেল

সারা দেশে রেলের ১০টি হাসপাতাল আছে। আছে ৩০টি ডিসপেনসারি, ১২টি ম্যাটারনিটি ও চাইল্ড কেয়ার সেন্টার। কোনো কিছুই ঠিকভাবে চলছে না।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল ১০০ শয্যার। কিন্তু এত দিন এই হাসপাতালে অভ্যন্তরীণ চিকিৎসার ব্যবস্থাই ছিল না। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর এটিকে কোভিড হাসপাতাল ঘোষণা করে কিছু শয্যা পাতা হয়। পদায়ন করা হয় চিকিৎসক, নার্স। দুই মাস পরে কোভিড হাসপাতালের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় হাসপাতালটি। তুলে নেওয়া হয় চিকিৎসক ও নার্স।

রেলের কর্মকর্তারা জানান, খারাপ অবস্থার কারণে হাসপাতালটির উন্নয়নে ২০১৫ সালে রেলওয়ে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। এরপর রেলওয়ে হাসপাতালের সাইনবোর্ড পরিবর্তন হয়ে ‘রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল’ হয়। আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। কেন?

রেলওয়ে সূত্র বলছে, হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণ করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাসপাতালের জমির মালিকানা চায়। রেল জমি দিতে রাজি নয়। ফলে হাসপাতালের উন্নয়নও আর হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জমি দিতে না চাইলেও রেল কর্তৃপক্ষ এখন বেসরকারি কোম্পানিকে জমি দিতে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে (পিপিপি) সারা দেশে এমন পাঁচটি হাসপাতাল প্রকল্প হাতে নিয়েছে রেলওয়ে। এগুলো হচ্ছে ঢাকার কমলাপুর, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, পাকশী ও খুলনা।

প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে, রেলে জমি ও স্থাপনা বিনিয়োগকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৪০-৫০ বছরের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে ১০৬টি মেডিকেল কলেজ আছে। এর মধ্যে সরকারি ৩৭টি, আর বেসরকারি ৬৯টি। এসব কলেজে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫২ হাজারের কিছু বেশি। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি জেলায় একটি করে সরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে সরকারের। এ অবস্থায় রেল কেন পাঁচটি মেডিকেল কলেজের নামে নিজেদের জমি বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। বর্তমানে যে মেডিকেল কলেজগুলো আছে, সেগুলোতে শিক্ষক দরকার অন্তত ২৫ হাজার। শিক্ষক আছেন ১০ হাজারের কম।

রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, চুক্তিতে লোকসান হলে বা লোকসান দেখিয়ে বিনিয়োগকারীরা চুক্তির মেয়াদ আরও বৃদ্ধি বা স্থায়ীভাবে জমি বরাদ্দের আবদার তুললে রেল কী করবে?

এই বিষয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বলেন, যেসব জমি অব্যবহৃত আছে, সেগুলোর সদ্ব্যবহারই এসব প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। এতে রেলের কিছু আয়ও বাড়বে। সারা দেশে এত মেডিকেল কলেজ থাকার পরও নতুন মেডিকেল কলেজ করা কতটা যৌক্তিক? এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিপুল। মানসম্মত হাসপাতাল-প্রতিষ্ঠান হলে উপকার হবে।

কমলাপুর

কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতালটি স্থাপন করা হয় ১৯৮৬ সালে। অবস্থান কমলাপুর স্টেশন ও শাহজাহানপুর মোড়ের মাঝামাঝি। ঠিক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ লাগোয়া। হাসপাতাল স্থাপনাসহ ফাঁকা জায়গা মিলে ৪ দশমিক ৩০ একর। গাছগাছালিও আছে বেশ কিছু।

হাসপাতালটিকে পিপিপিতে নিতে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৩ সালে। কোরিয়া সরকারের সঙ্গে জি টু জি পদ্ধতিতে অর্থায়নের আলোচনা চলছে।

প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে, কমলাপুরে ৫০ আসনের মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপন ও বিদ্যমান হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হবে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা।

রেলের এই হাসপাতালের দুই কিলোমিটারের মধ্যে আছে সরকারি মুগদা মেডিকেল কলেজ ও জেনারেল হাসপাতাল। ২০১৫ সালে চালু হওয়া এই মেডিকেল কলেজে আসনসংখ্যা ৭৫। আছে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল। রাজারবাগে আছে পুলিশ হাসপাতাল। এর বাইরে অসংখ্য বেসরকারি ক্লিনিক আছে এই এলাকায়।

চট্টগ্রাম

হাসপাতাল প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে চট্টগ্রাম হাসপাতাল। হাসপাতালটির উন্নয়নে গত মার্চে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। ঢাকায় ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানাধীন ইউনাইটেড হাসপাতাল রয়েছে। চুক্তি অনুসারে, বিদ্যমান হাসপাতালের পাশে ৫০ আসনের একটি মেডিকেল কলেজ, ৫০ আসনের নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং বিদ্যমান হাসপাতালটি আধুনিকায়ন করে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হবে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, বর্তমানে চট্টগ্রামে রেলের যে হাসপাতালটি রয়েছে, সেটিসহ আশপাশের জায়গা মিলে ছয় একর জমি দেওয়া হয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপকে। তাদের সঙ্গে চুক্তি ৫০ বছরের। এর মধ্যে নির্মাণকালই ১২ বছর। ইউনাইটেড গ্রুপ স্থাপনার নকশা প্রণয়ন, নির্মাণ অর্থায়ন ও পরিচালনা করবে।

আর্থিক চুক্তি অনুযায়ী, প্রাইভেট পার্টনার প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট ফি হিসেবে পিপিপি কর্তৃপক্ষকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা দেওয়ার কথা। রেলওয়েকে এককালীন দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি টাকা। চুক্তি স্বাক্ষরের তিন বছর পর প্রথম বার্ষিক ফি হিসেবে ৭৫ লাখ টাকা, চতুর্থ বছরে ৭৫ লাখ টাকা, পঞ্চম ও ষষ্ঠ বছরে চুক্তি ফি বাবদ দেড় কোটি টাকা করে রেলওয়েকে দেবে কোম্পানিটি। এরপর থেকে চুক্তির মেয়াদকাল পর্যন্ত প্রতি তিন বছরে একবার ১০ শতাংশ হারে ফি বৃদ্ধি পাবে।

চট্টগ্রামে একটি সরকারি ও চারটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে। এর বাইরে বেশ কটি বড় বেসরকারি হাসপাতাল আছে। আছে ছোট-বড় ক্লিনিকও। তবে এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সূত্র বলছে, ইউনাইটেড গ্রুপের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞতা আছে। ফলে প্রকল্পটি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

সৈয়দপুর

২০১৮ সালে নীলফামারী সদরে সরকারি একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও এখনো নিজস্ব ক্যাম্পাস হয়নি। এ জেলারই সৈয়দপুর উপজেলায় রেলের আগের হাসপাতাল ঘিরে একটি বড় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের প্রকল্প নিয়েছে রেলওয়ে। ২০১৩ সালে প্রকল্পটি নিলেও এখন পর্যন্ত খুব বেশি অগ্রগতি নেই।

প্রকল্পের নথি অনুসারে, বিদ্যমান হাসপাতাল ও এর আশপাশে জায়গা আছে ২৫ দশমিক ৫০ একর। এই জমির ওপর ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০ আসনের মেডিকেল কলেজ এবং বিদ্যমান হাসপাতাল ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হবে। বর্তমান হাসপাতালটি ৮২ শয্যার। অপারেশন থিয়েটার, এক্স-রে রুম, সার্জারি ওয়ার্ড, সাধারণ ওয়ার্ড, মহিলা ওয়ার্ড, কেবিনসহ চিকিৎসার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে হাসপাতালটিতে।

রেলওয়ের সূত্র বলছে, একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য রেলের ২৫ দশমিক ৫০ একর জমি দিয়ে দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী, নীলফামারীর সৈয়দপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও পাবনার পাকশীতে রেলের ছয়টি হাসপাতাল আছে।

পাকশী

পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার একটি ইউনিয়ন পাকশী। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আর রেলের বিভাগীয় কার্যালয় সেখানে। এখন ঈশ্বরদী উপজেলা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যও আলোচিত।

পাকশীতে রেলের বিপুল জমি, অবকাঠামো ও স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে রেলের ৭০ শয্যার একটি হাসপাতাল আছে। সেখানেও একটি বড় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের প্রকল্প নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পসংক্রান্ত নথি অনুসারে, ৫০ আসনের মেডিকেল কলেজ এবং বিদ্যমান হাসপাতাল ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার এই প্রকল্পে জমির পরিমাণ ২৫ একর। বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। এখানে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ আশা করছে রেল কর্তৃপক্ষ।

এই পাবনা জেলায় সরকারি একটি মেডিকেল কলেজ আছে। আশপাশের জেলাগুলোর মধ্যে রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ ও কুষ্টিয়াতেও সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে। সিরাজগঞ্জে বেসরকারি একটি বড় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল আছে।

খুলনা

খুলনায়ও রেল কর্তৃপক্ষ একটি নতুন মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও ২৫০ শয্যার হাসপাতাল করতে চাইছে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের জন্য জমি বরাদ্দ করা হয়েছে ১৫ দশমিক ৫২ একর।

খুলনায় সরকারি একটা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল আছে। ২০০৮ সালে এটিকে ২৫০ থেকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু এখনো জনবল ও যন্ত্রপাতি স্থাপন করা যায়নি। খুলনার পাশের জেলা সাতক্ষীরা, যশোর ও মাগুরায় সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এর বাইরে খুলনায় ও যশোরে দুটি করে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে।

সৈয়দপুরে বিশ্ববিদ্যালয়

হাসপাতাল ও শপিং মল প্রকল্পের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পও নিয়েছে রেল। এর জন্য রেলের জমি দীর্ঘ মেয়াদে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেওয়া হবে। বিনিয়োগকারী অবকাঠামো নির্মাণ করবে। এর জন্য নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে ১০০ একর জমি চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে।

যদিও সৈয়দপুরের কাছাকাছি দিনাজপুরে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, দেশে যেসব সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে, সেগুলোই ভালো চলছে না। এ পরিস্থিতিতে নতুন মেডিকেল কলেজ স্থাপনে রেলের কোনোভাবেই সম্পৃক্ত হওয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, যার যা কাজ, সেটাই করা উচিত। রেলের কাজ হচ্ছে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করা। সেটা না করে হাসপাতালে মনোযোগ দিলে কোনোটাই ভালো হবে না। (শেষ)