সাক্ষাৎকার

মেঘালয়ের অস্বাভাবিক বৃষ্টিতেই সিলেটের এই বন্যা

সিলেট অঞ্চলে হঠাৎ বন্যায় মানবিক বিপর্যয় হয়েছে। পরপর দুই দফায় বন্যার কবলে পড়ল অঞ্চলটি। এর কারণ এবং বাংলাদেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।

বুয়েটের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন

প্রথম আলো: হঠাৎ বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ অঞ্চলে বন্যায় ভারতের মেঘালয়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিকে একটা কারণ বলা হচ্ছে। আর কী কারণ আছে বলে আপনার মনে হয়?

সাইফুল ইসলাম: ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের (আইএমডি) দেওয়া তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখি, গতকাল মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা এ যাবৎকালের (রেকর্ড রাখার শুরু থেকে) তৃতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে এখানে ১৯৯৫ সালের ১৬ জুন ১ হাজার ৫৬৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। এরও আগে ১৯৫৬ সালের ৫ জুন ৯৭৩ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। আর গতকাল শুক্রবার হওয়া বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৯৭২ মিলিমিটার। এর আগে ১৫ জুন ৮১১ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। সেটিও ছিল অষ্টম সর্বোচ্চ বৃষ্টি। চেরাপুঞ্জির পাশের মাওসারাম এলাকায় গতকাল রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে, ১ হাজার ৩ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টি। তিন দিনের সমন্বিত বৃষ্টিপাতের হিসাব যদি দেখি সেখানে ১৯৯৫ সালে ১৪ থেকে ১৬ জুন বৃষ্টি হয়েছিল ২ হাজার ৭৯৮ মিলিমিটার। ১৯৯৭ সালের ১২ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর বৃষ্টি হয়েছে ২ হাজার ৭৬০ মিলিমিটার। আর গত ১৫ থেকে ১৭ জুন এই তিন দিন চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ২ হাজার ৪৫৭ দশমিক ২ মিলিমিটার। তিন দিনের সমন্বিত বৃষ্টির হিসাবে এবারকার বৃষ্টি তৃতীয় সর্বোচ্চ। প্রথম হোক বা তৃতীয় হোক, এটা একটা রেকর্ড।

গত এক সপ্তাহে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির হিসাব যদি দেখি ১২ জুন ৩৫৪, ১৩ জুন ২৯৩, ১৪ জুন ৬২ দশমিক ৬, ১৫ জুন ৮১১ দশমিক ৬, ১৬ জুন ৬৭৪ এবং ১৭ জুন ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আজ ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ১২ জুন থেকে আজ পর্যন্ত ৩ হাজার ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ বৃষ্টির পানি যাবে কোথায়? ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টির পর যদি তিন দিন বিরতি পাওয়া যায়, তবে এ পানি নেমে চলে যেত। আমার হিসাবে, এটি একটি অন্যতম ঐতিহাসিক বড় বৃষ্টি। আপনার প্রশ্ন অনুযায়ী বলতে পারি, চেরাপুঞ্জিতে সর্বোচ্চ রেকর্ডের বৃষ্টির কাছাকাছি বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টি এবার সিলেট অঞ্চলের বন্যার প্রধান কারণ। এর পাশাপাশি সুনামগঞ্জ ও সিলেটেও গত দুই দিন ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কেন এ ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে?

সাইফুল ইসলাম: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ভূমিকা আছে এখানে। গ্রিনহাউস গ্যাস বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে তাপমাত্রা। বেশি জলীয় বাষ্প তৈরি হচ্ছে। এদিকে আবার প্রশান্ত মহাসাগরে ‘লা নিনা’ অবস্থা বিরাজ করছে। এতে প্রচুর বৃষ্টি হয়। গত দুই বছর ধরে লা নিনা অবস্থা বিরাজ করছে। এই অঞ্চল প্রশান্ত মহাসাগর থেকে দূরে, তবে পৃথিবীর নানা স্থানে প্রশান্ত মহাসাগরের এই বিশেষ পরিস্থিতির প্রভাব (টেলিকানেকশন) আছে। আবার ‘এল নিনো’র প্রভাবে এই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খরা দেখা দেয়। তবে বন্যার আরও কারণ হলো, আমাদের ভূমির ব্যবহারের ধরন পাল্টে গেছে। নতুন করে স্থাপনা হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে। এসবের তো ভূমিকা আছে। আবার পলি পড়ছে প্রচুর। এগুলো সরছে না। এমন নানা কারণ আছে বন্যার। আর আগে যেমন বন্যার পানি দ্রুত নেমে যেতে পারত, এখন তা পারছে না। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সিলেট অঞ্চল সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার বন্যার মুখে পড়ল। বারবার এ বন্যার কারণ কী? হাওর অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ কি একটি কারণ?

সাইফুল ইসলাম: বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই বন্যা হয়। বেশি বৃষ্টি হয়ে বন্যা হতেই পারে। এবার পরপর দুবার বন্যা হলো এবং দুটোই বড়। সাধারণত মে মাসে এত বড় বন্যা হয় না, তবে সিলেট অঞ্চলে এবার তাই হয়েছে। সেই বন্যার একটি কারণ হলো, ঘূর্ণিঝড় অশনির কারণে বৃষ্টিপাত। অশনি ভারতের ওডিশা হয়ে চলে গেছে। সেই সময় ঘূর্ণিঝড়ের সার্কুলেশনের জন্য প্রচুর আর্দ্রতা তৈরি হয় মেঘালয় অঞ্চলজুড়ে। এর প্রভাবে সেখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে মে মাসে সিলেটে বন্যা হয়। আর এখন যেটা হচ্ছে, এখন কিন্তু মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ সময়টায় পাহাড়ে বৃষ্টিপাত হয়। জলীয় বাষ্প পাহাড়ে বাধা পেয়ে ওপরের দিকে উঠে ঘনীভূত হয় এবং বাষ্প বৃষ্টিকণায় পরিণত হয়।

মেঘালয়ের এই পানি হাওর অঞ্চল আসে। হাওর একটি গামলার (বোল) মতো, এখানে এসে পানি জড়ো হয়। পরে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়।

হাওরে যেসব অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে, সেগুলো বন্যার কারণ নয়, কিন্তু সেগুলোর কারণে বন্যা দীর্ঘায়িত হবে। অবকাঠামোগুলোকে পানিতে ডুবে থাকা (সাবমারসিবল) অবস্থায় করতে হবে। কিছু সড়ক হয়ে, এ ক্ষেত্রে মিঠামইনের সড়কের কথা বলা হয়। এটাই একমাত্র কারণ নয় কিন্তু। সরকার এখন উড়ালসড়ক নির্মাণের কথা বলছে, সেটা খুব যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত বলে আমার মনে হয়। এটা আরও আগে করতে পারলে ভালো হতো। তবে এক উপজেলার সঙ্গে আরেক উপজেলার যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক সময় সড়কের বিকল্প নেই। তবে যেখানে যা দরকার, যেমন কোথাও সাবমারসিবল, কোথাও উড়ালসড়ক করতে হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: মাসের শুরুতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস ছিল মাসের মাঝামাঝিতে বন্যা হতে পারে। এ ধরনের বন্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি কি আমাদের ছিল?

সাইফুল ইসলাম: আমি বলব, হয়তো পুরোপুরি ছিল না। এমন অস্বাভাবিক বৃষ্টি হবে, সেটা হয়তো ভাবনাতেও ছিল না। এবার বন্যায় খাদ্যের গুদাম নষ্ট হয়েছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, আমরা এমনভাবে এসব তৈরি করিনি। আবার আমাদের পূর্বাভাস থাকলেও, এই পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তা হয়তো আমরা কেউ ভাবিনি। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সুনাম আছে। তবে তা জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে যতটা কার্যকর, মানুষের সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে তা নয়। আমরা বন্যা পরিস্থিতির আগাম বার্তা পেতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে পারি। অভিন্ন অববাহিকায় থাকার কারণেই এটা করতেই হবে। সেটা কতটুকু করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এবার বন্যায় বিদ্যুতের একাধিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ধরনের স্থাপনা তৈরিতে কী কী বিষয় বিবেচনায় নেওয়া উচিত?

সাইফুল ইসলাম: আগে আপনাকে বলেছি, খাদ্যগুদামও নষ্ট হয়েছে। বিদ্যুতের উপকেন্দ্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে বন্যার ঝুঁকি বিবেচনায় নেওয়া উচিত যথাযথভাবে। বুঝতে হবে, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। আমাদের যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণে তাই সুদূরপ্রসারী ভাবনা থাকতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। এটা বাস্তবতা। একে উপেক্ষা করলে ভবিষ্যতে আরও বড় আকারের ক্ষতির মুখে আমরা পড়ব। এবারের প্রস্তুতির প্রশ্নে বলতে পারি, সেটা যথেষ্ট ছিল না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এ ধরনের হঠাৎ বন্যা মোকাবিলায় কী ধরনের প্রস্তুতি থাকা উচিত বলে আপনার মনে হয়। আপনার কী কী সুপারিশ থাকবে?

সাইফুল ইসলাম: দুই ধরনের ব্যবস্থার কথা বলতে পারি। এক হলো, অবকাঠামোগত ব্যবস্থা। এর মধ্যে আছে বাঁধ, ড্রেজিং, ডাইভারশন, স্লুইচগেট নির্মাণ। আর অন্য উদ্যোগের মধ্যে আছে আগাম বার্তা, অধিক হারে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের মতো কাজ করা যেতে পারে। বন্যার জন্য ফসলের বিমা একটি উদ্যোগ হতে পারে। আর যেটা দরকার, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তথ্য আদান–প্রদানে ব্যাপকহারে উদ্যোগী হওয়া দরকার। আর অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারের আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় নেই। সেটা বাড়াতে হবে। দরকার জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানো। ১৯৮৮ বা ১৯৯৮ সালের মতো ভয়াবহ বন্যার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। সেখানে মানুষের সহযোগিতা ছিল অসামান্য। সেসব কিন্তু অনেকটা কমে গেছে। মানুষকে তাই সম্পৃক্ত করতে হবে।