>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
করোনার শুরু থেকেই ভয়ের মধ্যে ছিলাম। আমার ফুসফুস দুর্বল, তাই করোনায় আক্রান্ত হলে বাঁচার সম্ভাবনা কম। একজন সুস্থ মানুষের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা যেখানে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ, আমার সেখানে ৫৮ থেকে ৬০। ফুসফুস দুর্বল; কারণ, ৪০ বছর ধরে অ্যাজমা। এ জন্য শুরু থেকেই দেশ-বিদেশের ডাক্তার বন্ধুরা ভাইরাসটি সম্পর্কে আমাকে সাবধান করছিল। নিজেও বুঝছিলাম, করোনা আমার জন্য কত বড় হুমকি। তাই যতটা সম্ভব সাবধান ছিলাম। তবে কথায় আছে, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়’। আমার ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটল। অর্থাৎ আক্রান্ত হলাম।
রোজা প্রায় শেষের দিকে। নিয়মিত রোজা রাখছি। হঠাৎই শরীর ভীষণ দুর্বল অনুভব হতে থাকল। খাবারের স্বাদ ও রুচি হারানো এবং হালকা জ্বর ছাড়া আমার অন্য কোনো উপসর্গ ছিল না। তাপমাত্রা কখনো ১০০ অতিক্রম করেনি। ওই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস করছিলাম। ১৮ মে অফিসে অসুস্থতা বোধ করায় তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে গেলাম। প্রাথমিক সব উপসর্গের কথা শুনে আমার ছেলে তানভীর আহমেদ (শেল্টেক্ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ঘাবড়ে গেল। একজন ডাক্তারের পরামর্শে আইভারমেকটিন ও ডক্সিসাইক্লিন শুরু করলাম। তখনো করোনায় আক্রান্ত কি না, জানি না। ১৯ মে আমি ও আমার স্ত্রী রাশিদা আহমেদ করোনা পরীক্ষা করতে দিলাম। ফল আমার পজিটিভ। স্ত্রীর নেগেটিভ, এমনকি পরিবারের অন্য সদস্যদের ফলও নেগেটিভ।
করোনা পরীক্ষার ফল জানার পর আমাকে জানাতে তানভীর ভয় পাচ্ছিল। তবে উপসর্গগুলোর কারণেই আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল এবং ইতিবাচক ছিলাম। খবরটার প্রাথমিক ধাক্কা সামলানোর পর আমার পরিবারের সামনে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায় হাসপাতাল। কারণ, হাসপাতাল ছাড়া অক্সিজেন, ভেন্টিলেশন ও আইসিইউ সেবা পাওয়া যাবে না। ওই সময়ে হা–মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ ভাই ফোন করে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিলেন। জানালেন, তিনিও আক্রান্ত হয়ে স্কয়ারে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং সুস্থ হয়ে তখনই বাড়ি ফিরছেন। যদিও থাকতে হবে করোনা ওয়ার্ডে। এর আগেই অবশ্য ব্যবসায়ী সমাজ ও আমার অভিভাবক মাহবুব ভাই (ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের সভাপতি) বিভিন্ন জায়গায় কথা বলতে শুরু করেন। স্কয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি দ্রুত একটা শয্যার ব্যবস্থা করলেন।
হাসপাতালে ভর্তি হলাম ২২ মে। দ্রুতই ওয়ার্ডের সঙ্গে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিলাম। অনেক রোগী। কমন বাথরুম। ওয়ার্ডের পরিবেশও ভালো। চিকিৎসক, নার্স—সবাই ভীষণ আন্তরিক। সমস্যা হলো, কিছুই খেতে পারি না। অথচ হাসপাতাল থেকে প্রচুর পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হতো। তবে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ছিলাম। আমার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কখনো ৯৫–এর নিচে নামেনি। এবং ওই সময়ে করোনা ওয়ার্ডে আমিই একমাত্র রোগী, যার অক্সিজেন প্রয়োজন হয়নি। এর কারণ সম্ভবত নিউমোনিয়া ইনজেকশন বা নিউমোনিয়া শট। বছর চারেক আগে নিয়মিত চেকআপের সময় সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা দেখতে পান, আমার ফুসফুসের কার্যক্ষমতা মাত্র ৩৩ শতাংশ। তখন দুর্ঘটনা এড়াতে চিকিৎসকেরা আমাকে নিউমোনিয়া শট দেন। এতে আমার ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বেড়েছে। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শ হচ্ছে, যাঁদের বয়স ৫০ বা বেশি, তাঁদের প্রতি ১০ বছরে একবার এই ইনজেকশনটা নেওয়া উচিত। তাহলে বহু জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।
পাশাপাশি প্রতিবছর একবার করে ফ্লু শট নেওয়া উচিত। আমিও নিয়েছি। এই ডোজ নেওয়া থাকলে ফ্লুতে আক্রান্ত হলেও আচমকা অনেক জ্বর উঠে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় না। চিকিৎসকেরাও মনে করেন, নিউমোনিয়া ও ফ্লু–প্রতিরোধী আগাম ডোজ নেওয়া থাকার কারণেই এই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছি।
যাহোক, হাসপাতালের প্রতিটি দিন ও রাত ছিল দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। এ সময় পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলা, অসুস্থতার খবরে ভালোবাসা ও দোয়াপূর্ণ যেসব বার্তা আসত, প্রতিটির উত্তর দেওয়া, মেইল দেখা এবং প্রার্থনায় সময় কাটত। বাকি সময় ঘুমাতাম। মাঝেমধ্যে মুঠোফোনে অনলাইন সংবাদপত্রে চোখ বোলাতাম। যতটা সম্ভব নেতিবাচক খবর থেকে দূরে থাকতাম।
হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসক বললেন, সক্রিয় থাকতে হবে। ফলে ওয়ার্ডের ভেতরে হালকা হাঁটাহাঁটি এবং নিশ্বাসের ব্যায়াম করতাম। এরও আগে থেকে গড়গড়া করা, গরম পানির ভাপ নেওয়া, কুসুম গরম পানি পানের মতো নিয়মকানুন শতভাগ মেনে চলেছি। লেবু–চা, ভিটামিন সি খেয়েছি। হাসপাতালে থাকতে থাকতেই ঈদ এল। নিঃসঙ্গ, বিষণ্ন ও হাহাকার ভরা একটা ঈদ। প্রিয় কিংবা দূরেরজন—কারও সঙ্গে দেখা ছাড়াই কাটল ঈদ।
হাসপাতালে থাকতেই তানভীর আমার জন্য একজন প্লাজমা ডোনার ঠিক করে রাখলেও দরকার হয়নি। ২৯ মে অন্য একজন সংকটাপন্ন রোগীর জন্য ডোনার ছেড়ে দিতে বললাম। সেদিন হাসপাতালে শুয়ে সংকটাপন্ন একজন মানুষের উপকার করতে পেরে অনেক ভালো লেগেছিল।
করোনা এত জীবন কেড়ে নিলেও মৃত্যুভয় ছিল না আমার। গত বছরের জুন মাসে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ড. তৌফিক এম সেরাজ প্লেনের মধ্যে, আমার হাতের ওপর মারা যায়। তৌফিক গত হওয়ার পর মৃত্যু নিয়ে আর ভাবি না; বরং জীবনের কথা ভাবি। হাসপাতালের সময়টাতেও কল্যাণকর ও আনন্দদায়ক জীবনের কথাই বারবার ভেবেছি।
জীবনে প্রথমবার এতটা অখণ্ড অবসর মিলেছিল। তখন নিজেকে সময় দিয়েছি। নিজেকে আরও ভালো করে চিনতে পেরেছি। জীবনের ভুলগুলো এবং ঠিকগুলো নতুন করে বুঝতে পেরেছি। জীবন, সম্পর্ক, পরিবার, রাষ্ট্র, রাজনীতি নিয়ে নতুন উপলব্ধি হয়েছে। দেশ-সমাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সময়কে বিশ্লেষণ করেছি। এত দিন পর্যন্ত শুধু ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং লাভ ও লোকসান নিয়ে ভেবেছি। থামার সময় মেলেনি। প্রকৃতি সবাইকে যেন থামার বা বিশ্রামের সুযোগ করে দিয়েছে। এই সুযোগ আমি কাজে লাগিয়েছি। সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করেছি।
মাঝেমধ্যে ওপর থেকে নিচে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। রাস্তার দুই ধারে অনেক ক্ষুধার্ত মানুষ। করোনা এই মানুষগুলোর মতো
আরও বহু মানুষের জীবিকা কেড়ে নিয়েছে। হাসপাতালে বসেই তাদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেছি। আশা করছি সারা দেশের মানুষের জন্য কিছু করব।
জুনের শুরুতে পরীক্ষার ফল আবার পজিটিভ এল। চিকিৎসক চিন্তা করতে মানা করলেন। বললেন, দ্রুতই ফল নেগেটিভ আসবে। শরীর ভালো থাকায় ৪ জুন বাসায় চলে এলাম। এরপর আবার পরীক্ষা করালে প্রতিবারই করোনা নেগেটিভ ফল আসে। আমি করোনামুক্ত হই।
সবশেষে আপনারা সবাই সাবধানে থাকুন। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন। যতটা সম্ভব শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। নিজের যত্ন নিজে নিন। পরিবারকে ভালোবাসুন ও সময় দিন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
বাংলাদেশ করোনামুক্ত হোক—এই প্রার্থনা।