করোনায় মৃত্যু কমছে না। কী পরিস্থিতিতে এসব মৃত্যু হচ্ছে তা জানার কোনো উদ্যোগ স্বাস্থ্য বিভাগের নেই। মৃত্যু কমানোর চেষ্টাও চোখে পড়ে না। তবে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মৃত্যু কমানোর লক্ষ্য নিয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিলে কিছু মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যুও বাড়বে। গত ১৫ দিন নমুনা পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। এ সময়ে অধিকাংশ দিন মৃত্যু হয়েছে দুই শ বা তার বেশি।
আবু জামিল ফয়সালসহ কয়েকজন জনস্বাস্থ্যবিদ নিজেদের উদ্যোগে করোনার মৃত্যুর কারণ ও ধরন নিয়ে একটি গবেষণা করছেন। আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সামগ্রিক উদ্যোগ করোনায় মৃত্যু কমানোতে প্রভাব ফেলে। যেমন টিকাগ্রহীতারা আক্রান্ত হলেও তাঁদের মধ্যে মৃত্যু খুবই কম। আবার জরুরি অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে আসা সব রোগীকে বিলম্ব না করে অক্সিজেন সরবরাহসহ চিকিৎসা শুরু করতে পারলে মৃত্যু কমবে।’
গতকাল শনিবার করোনায় আরও ১৯৫ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ পর্যন্ত দেশে করোনায় মারা গেছেন ১৯ হাজার ৪৬ জন।
গত বছর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়। সেই খবরে একধরনের আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। পাশাপাশি এটাও প্রচার হতে থাকে যে প্রবীণ এবং ডায়াবেটিস বা হৃদ্রোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা ব্যক্তিরা করোনা আক্রান্ত হলে তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। নারীদের মধ্যে সংক্রণ হার ও মৃত্যু দুই–ই পুরুষের তুলনায় বেশি ছিল।
তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন চোখে পড়ছে। অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে মৃত্যু বাড়ছে। মৃত্যু বাড়ছে নারীদের মধ্যে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত কিছুদিনের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের করোনায় মৃত্যু বাড়ছে। পাশাপাশি নারীদের মৃত্যুঝুঁকি কম, সেটিও আর আগের মতো করে বলা যাচ্ছে না।’
কেন মৃত্যু বাড়ছে? কেন কম বয়সীরাও করোনায় মারা যাচ্ছে? কেন নারীদের মধ্যে মৃত্যুহার বাড়তে দেখা যাচ্ছে? এসব প্রশ্নের সোজাসাপটা কোনো উত্তর কারও জানা নেই।
আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন বলেন, সংক্রমণের সঙ্গে মৃত্যুর আনুপাতিক সম্পর্ক আছে। সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যু বাড়বে। এখন সংক্রমণ বৃদ্ধির মূল কারণ করোনার ডেলটা ধরনের (ভারতে উৎপত্তি) বিস্তৃতি। এর সংক্রমণ ক্ষমতাও বেশি। ডেলটা ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের তীব্রতা বেশি দেখা দেয়। তবে কম বয়সী বা নারীদের বেশি মৃত্যুর পেছনে ডেলটা ধরন কাজ করছে কি না, তা নিয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল হাতে নেই।
দেশে করোনাভাইরাসের জিন বিশ্লেষণের সঙ্গে শুরু থেকে যুক্ত আছেন বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রধান অধ্যাপক সমীর সাহা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আক্রান্তদের ৯০ শতাংশের পেছনে আছে ডেলটা ধরন।’
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ বছর ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল—এ তিন মাসে মারা যাওয়া ২০০ করোনা রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন একদল চিকিৎসক ও গবেষক। মৃত ব্যক্তিদের গড় বয়স ছিল ৬২ বছর। তাঁদের ১২০ জন ছিলেন পুরুষ, নারী ছিলেন ৮০ জন। মৃত্যু বেশি ছিল ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সসীমার মধ্যে। মৃত ব্যক্তিদের ৬৪ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ এবং ৫৬ শতাংশের ডায়াবেটিসের ইতিহাস ছিল।
মৃত্যুর সময়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মৃত ব্যক্তিদের ৫১ জনের অর্থাৎ ২৫ দশমিক ৫ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক রুবিনা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আক্রান্তদের অনেকেই শারীরিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর হাসপাতালে আসছেন। হাসপাতালে পৌঁছানোর সময় অক্সিজেনের মাত্রা এত কম থাকে যে তখন চিকিৎসকদের আর বিশেষ কিছু করার থাকে না।’ মানুষকে সচেতন করারও প্রয়োজন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার আগেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনতে হবে। এ জন্য বাসায় পালস অক্সিমিটার রাখতে হবে অথবা কোথায় তা পাওয়া যায়, তা জেনে রাখতে হবে।’
করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় অনেকেই জরুরি প্রয়োজনে অক্সিজেন–সহায়তা পাচ্ছেন। এ উদ্যোগ মৃত্যু কমাতে ভূমিকা রেখেছে বলে জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন। তবে তাঁরা এ–ও মনে করেন, অনেক ক্ষেত্রে জরুরি রোগী চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতালগুলো প্রস্তুত থাকে না। সময়মতো অক্সিজেন সহায়তা না দেওয়ার যে অভিযোগ পাওয়া যায়, তার পেছনে আছে জনবলস্বল্পতা ও দক্ষতার ঘাটতি। সরকার চাইলে জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতার ঘটতি দূর করে কিছু প্রাণ রক্ষা করতে পারে।
অন্যদিকে টিকা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ, তাঁদের আগে টিকা দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকা পাওয়া ব্যক্তিরা আক্রান্ত হলেও তাঁদের হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয় কম। হাসপাতালে গেলেও তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। সব মানুষকে টিকা দিতে হবে, না পারলে বয়স্কদের আগে টিকা দিতে হবে।’