মৃত্যুর পর বেঁচে থাকব কি না, সেটি আমার সাধনা: মুর্তজা বশীর

শিল্পী মুর্তজা বশীরকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: তানভীর আহমেদ
শিল্পী মুর্তজা বশীরকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: তানভীর আহমেদ

শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেছেন, ‘আজীবন সম্মাননা শুনতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু আমি মোটেও আনন্দিত নই। কেননা জীবিত অবস্থায় কী পেলাম, সেটি বড় কথা নয়; মৃত্যুর পরে আমাকে স্মরণ করা হবে কি না, সেটিই হলো আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া।’ তিনি বলেছেন, ‘আমি জীবনভর চেষ্টা করেছি এখন কী পেলাম, সেটি আমার কাছে কিছু না। মৃত্যুর পর বেঁচে থাকব কি না, সেটি হলো আমার সাধনা।’

‘শিল্পের আলোয় মাতৃভাষা উদযাপন’ শিরোনামে আজ শনিবার রাতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও আর্টোপলিটন যৌথভাবে ১৫ দিনব্যাপী চিত্রকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন শিল্পী মর্তুজা বশীরকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। শিল্পী মুর্তজা বশীর অনুভূতি প্রকাশের সময় এসব কথা বলেন।

ছোটবেলায় বন্ধু বিয়োগের ঘটনা তুলে ধরে শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেন, ‘ছোটবেলায় বইতে পড়েছিলাম মানুষ মরণশীল। কিন্তু তখন আমার অন্তরাত্মা বলে উঠল, না, মানুষ মরণশীল না। মানুষ অবিনশ্বর।’ এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমি জীবনভর চেষ্টা করেছি এখন কী পেলাম, সেটি আমার কাছে কিছু না। মৃত্যুর পর বেঁচে থাকব কি না, সেটি হলো আমার সাধনা। আমি বিশ্বাস করি, এখন কী পেলাম সেটি বড় কথা নয়। চিত্রকলা হোক, সাহিত্য হোক—সময়কে অতিক্রম করে যদি কেউ সৃষ্টি করতে না পারেন, সেটি লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট হবে না।’

নিজের জীবনে সময়কে অতিক্রম করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেন, ‘আপনারা দোয়া বলুন, আশীর্বাদ বলুন—আমাকে আশীর্বাদ করুন, আমার যে স্বপ্ন, সময়কে অতিক্রম করা, সেটি যেন সফল হয়।’ এ সময় মিলনায়তন ভর্তি অতিথিরা হাততালি দিয়ে শিল্পীর প্রতি শুভেচ্ছা জানান।

শিল্পী মুর্তজা বশীরকে সম্মাননা প্রদান করছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: তানভীর আহমেদ

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫১ সাল থেকে। আমাদের বন্ধুত্ব ছয় দশক পেড়িয়ে সাত দশকে পড়তে যাচ্ছে। বশীরকে আমি শ্রদ্ধা করি তাঁর বহুমুখী প্রতিভার জন্য। তিনি চিত্রশিল্পী। তিনি উডকাট, লিনোকাট, জলরং, তেলরং, বস্তুধর্মী সব রকমের কাজ করেছেন। বিচিত্র তাঁর গতিবিধি। চিত্রশিল্পের প্রায় সব মাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন। এটি সামান্য ব্যাপার নয়।’

ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বশীর শুধু চিত্রশিল্পী নন, তিনি কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক। সাহিত্য ছাড়া তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, নির্দেশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই মানুষটি বিচিত্রভাবে এত কিছু ধারণ করেন, সেটি ভেবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হতে হয়। বশীর একজন বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী। ভাষা আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন। বশীরকে সম্মাননা ও শ্রদ্ধা জানানো উপযুক্ত কাজ হয়েছে।’

‘শিল্পের আলোয় মাতৃভাষা উদযাপন’ শিরোনামে ১৫ দিনব্যাপী চিত্রকলা প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। অতিথিদের সঙ্গে সেরা পুরস্কার ও সম্মাননা পাওয়া শিল্পীরা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: তানভীর আহমেদ

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক ও প্রকাশক মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, ‘আমি মর্তুজা বশীর স্যারের কাজের ভক্ত। তাঁর সম্পর্কে জানার চেষ্টা, তাঁকে শ্রদ্ধা করার একটি বিরাট আবেগ আমার মধ্যে কাজ করে। যে জাতি তার শিল্পীদের, সৃজনশীল ব্যক্তিদের, লেখকদের সম্মান করে না, সে জাতি আসলেও খুব একটি উন্নতি করতে পারে না।’ এ সময় মাহ্‌ফুজ আনাম তাঁর বাবা আবুল মনসুর আহমদের একটি উক্তি বলেন। তাঁর বাবা বলতেন,‘লেখকদের সম্মান করতে চাইলে তাঁদের বই কিনে পড়ো।’

মাহ্‌ফুজ আনাম আরও বলেন, ‘আমরা কথা দিয়ে অনেক শ্রদ্ধা প্রকাশ করি। তারপর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে কতটুকু সেই শ্রদ্ধা ধরে রাখি, সেটি সম্পর্কে আমি সাংবাদিক হিসেবে আমার অনেক প্রশ্ন আছে। আমি একটু অনুরোধ করব, আমরা কথায় যেভাবে বলি, যে আন্তরিকতা-উৎসাহ দেখাই, সেটি যেন মন থেকে হয়। আমরা একটুখানি বেশি কথার জাতি হয়ে যাচ্ছি, সবকিছুর মধ্যে একটি চাটুকারিতা। ওই মুহূর্তের প্রকাশের মাধ্যমে বিরাট শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর মুহূর্তে অন্যদিকে মনটাকে ধাবিত করে আসল কাজ থেকে সরে যাওয়া—এগুলো আজ অনেক কিছু দেখা যায়।’ এসব থেকে বিরত থেকে প্রকৃত শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা প্রকাশের অনুরোধ করেন মাহ্‌ফুজ আনাম।

আয়োজক সংগঠন আর্টোপলিটনের কিউরেটর জাহাঙ্গীর আলম অনুষ্ঠানের বিষয়ে বলেন, বিশ্বের ৩২টি দেশ থেকে ২ হাজার ২৭৯টি কাজ প্রদর্শনীর জন্য জমা পড়েছিল। এর মধ্য থেকে ২১২টি কাজ প্রদর্শনীর জন্য স্থান পেয়েছে। এর মধ্য থেকে বিচারকেরা একজনকে সেরা পুরস্কার ও চারজনকে সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করেছেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: তানভীর আহমেদ

সেরা পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পী কুন্তল বাড়ই। সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন ভারতের স্বপন দাস, বাংলাদেশের মো. আনিসুল হক, মালয়েশিয়ার ফাদলি সাবরান এবং বাংলাদেশের সামিয়া আহমেদ।

মনিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শিল্পী মুর্তজা বশীরের ওপর সংশাবচন পাঠ করেন রশিদ আমিন। এ ছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অ্যাস্রোটেক্স গ্রুপের পরিচালক তামান্না তাহমিনা। অনুষ্ঠান শেষে ১৫ দিনব্যাপী চিত্রকলা প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়।