মূল আসামিরা ধরা পড়েনি

রিফাত হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের মানববন্ধন। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে। ছবি: প্রথম আলো
রিফাত হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের মানববন্ধন। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে।  ছবি: প্রথম আলো

পুলিশ বলছে, তারা সর্বশক্তি দিয়েই বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে হত্যাকাণ্ডের তিন দিনেও মূল তিন আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন, রিফাত ফরাজী ও তাঁর ভাই রিশান ফরাজী গ্রেপ্তার হননি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, পেছনে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রশ্রয় থাকায় এই তিনজন নানা অপকর্ম করে বারবার পার পেয়ে যাচ্ছেন।

এখন পর্যন্ত পুলিশ বলছে, সাব্বিরের সঙ্গে রিফাত শরীফের ব্যক্তিগত বিরোধকে কেন্দ্র করেই এই হত্যাকাণ্ড। রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাকে আগে থেকে উত্ত্যক্ত করতেন সাব্বির। আয়শাকে তিনি বিয়ে করতে চান বা আয়শার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে—এ রকম কথাও তিনি পরিচিত মহলে ছড়িয়েছেন। দুই মাস আগে আয়শার সঙ্গে রিফাতের বিয়ের পর সাব্বির ফেসবুকে নানা আপত্তিকর পোস্ট দেওয়া শুরু করেন। বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন নিহত রিফাত। এই বিরোধই শেষ পর্যন্ত নৃশংস হত্যাকাণ্ডে গড়ায়।

পুলিশ বলছে, নিজের বিরোধের প্রতিশোধ নিতে সাব্বির তাঁর বন্ধু ও সহযোগীদের সাহায্য নেন। তাঁর গড়ে তোলা জিরো জিরো সেভেন (০০৭) ফেসবুক গ্রুপের বেশ কয়েকজন সদস্যও ওই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজে এঁদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাও বলেছেন, ভিডিওতে থাকা ওই তরুণেরাই তাঁদের প্রথমে আটকে তাঁর স্বামীকে মারধর শুরু করেন।

গত বুধবার সকালে বরগুনা শহরের কলেজ রোড এলাকায় প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পরদিন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম মামলা করেন।

মামলায় সাব্বির, রিফাত, রিশানসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার পুলিশ এজাহারভুক্ত দুই আসামি চন্দন ও হাসানকে সাত দিন করে এবং সন্দেহভাজন আসামি নাজমুলকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক মো. রাসেল এই আদেশ দেন।

মুঠোফোনে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, নিহত রিফাতকে লম্বা দা দিয়ে উপর্যুপরি কোপাচ্ছিলেন দুজন। তাঁদের একজন সাদা জামা পরা সাব্বির। অন্যজন কালো জামা, কালো সানগ্লাস পরা রিফাত ফরাজী। রিফাত ফরাজীর ভাই রিশান ফরাজী ও তাঁর সহযোগীরাই কলেজমাঠ থেকে মারতে মারতে রিফাত শরীফকে কলেজের বাইরের রাস্তায় নিয়ে এসেছিলেন। এ সময় কলেজের সামনের রাস্তার উত্তর ও পূর্ব পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রিশানের সেই সহযোগীরা। পুলিশ জানিয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কলেজ রোডের বাসিন্দা টিকটক হৃদয়, ডিকেপি রোডের রায়হান, কলেজিয়েট স্কুল রোডের মুহাইমিনুল ইনলাম ওরফে সিফাত, ধানসিঁড়ি সড়কের বাসিন্দা তানভীর হোসেন এবং সোনালীপাড়া এলাকার রিফাত। তাঁরা সবাই রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আসামি। পুলিশ জানিয়েছে, এই পাঁচজনের সবাই ছাত্র। তাঁরা বিভিন্ন কলেজে পড়েন, কেউ এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন।
ভিডিওতে সবুজ টি-শার্ট পরা একজনকে দেখা যায় হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে। তিনি জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সাহস করে ওদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই থামানো গেল না। রক্তে ভিজে যাচ্ছিল ছেলেটি।’

বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন গতকাল বলেন, এই মামলায় এরই মধ্যে এজাহারভুক্ত দুই আসামি এবং ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরে আরেকজনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আসামিরা নজরদারির মধ্যে এসেছে। অচিরেই দেশবাসীকে আমরা সুখবর দিতে পারব বলে আশা করছি। কোনো আসামি গ্রেপ্তার এড়াতে পারবে না।’

>

পুলিশ বলছে, হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন ০০৭ গ্রুপের সদস্যরা
রিফাতকে কোপান দুজন
অন্যরা সহযোগিতা করেছেন

পুরোনো অপরাধী সাব্বির, রিফাতদের বিরুদ্ধে এখন নানা অভিযোগ উঠছে। তাহলে এত দিন পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চাইলে বরগুনার পুলিশ সুপার বলেন, সাব্বিরের বিরুদ্ধে দুটি মাদক, একটি অস্ত্রসহ আটটি মামলা রয়েছে। আটটি মামলাতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, পরে তিনি আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। সব কটি মামলাতেই পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল। আর রিফাত ফরাজীর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা ছিল। তিনটিতেই তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন। এ মামলাগুলোর তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ।

নিহত রিফাত শরীফ

বরিশালের পুলিশ জানায়, আসামিদের ধরতে বরিশাল বিভাগের সব কটি জেলা ও উপজেলায় গোয়েন্দা পুলিশ ও সাদাপোশাকধারী পুলিশের তৎপরতা রয়েছে। দূরপাল্লার বাস, লঞ্চগুলোতেও তল্লাশি চালানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে বরিশাল নদীবন্দর এলাকায় কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ তল্লাশি চালানোর সময় সন্দেহভাজন চার যুবককে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রিফাত হত্যার সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগসাজশ না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হলে পরিবারের জিম্মায় রাতেই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক সফিকুল ইসলাম গতকাল বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারে শুধু বরিশাল বিভাগ নয়, সারা দেশে তৎপরতা চলছে। তারা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকার নিরাপত্তায় তাঁর বাবার বাড়িতে গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আয়শার চাচা আবু সালেহ বলেন, রিফাত শরীফ নিহত হওয়ার পর থেকেই আয়শা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য পুলিশের কাছে আবেদন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।