আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে গত বুধবার হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’। তিনি ২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আলোচনায় এসেছিলেন। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম। তিনি ‘রোহিঙ্গা: নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী’ বইটির লেখক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক পার্থ শঙ্কর সাহা।
প্রথম আলো: মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তার ওপর এর প্রভাব কী?
এমদাদুল ইসলাম: যেকোনো হত্যাকাণ্ড দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক। মুহিবুল্লাহর হত্যার বিষয়টিও তাই। নেতৃত্বহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একজন নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ জাতিগোষ্ঠীর মানুষের দাবিকে সামনের কাতারে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর লেখাপড়া ছিল। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের বৈঠকও গেছেন। বছর দুয়েক আগে রোহিঙ্গাদের বড়সর সমাবেশ করেছেন। যেখানে নেতৃত্বই ছিল না তার মধ্যে সবেধন নীলমণি বলতে যা বোঝায় তিনি তাই ছিলেন। তাই তাঁর হত্যাকাণ্ড দুর্ভাগা রোহিঙ্গাদের জন্য বেশি দুর্ভাগ্যজনক। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষের নেতা ছিলেন, তাই তাঁর এই হত্যাকাণ্ড আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্যও দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, তাঁর অবস্থানকে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারত। সব মিলিয়ে একটা বড় ক্ষতি হয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য।
প্রথম আলো: এ হত্যাকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে কী ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে?
এমদাদুল ইসলাম: বাংলাদেশ খুব বড় সমস্যায় পড়বে বলে মনে হয় না। তবে মুহিবুল্লাহর মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াকে সংগঠিত করা যেত। বাংলাদেশ তো সমস্যার মধ্যে এমনিতেই আছে। চার বছর হয়ে গেছে, প্রত্যাবাসন নিয়ে কিচ্ছু এগোয়নি। এর কোনো আলামতও দেখা যাচ্ছে না। যদি প্রত্যাবাসনের মাঝামাঝি এ হত্যাকাণ্ড হতো তবে হয়তো সমস্যা হতো। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতো। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিবৃতি দিয়ে একে দুঃখজনক বলেছেন। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্য বিবৃতি দিয়ে এর সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছে। এসব বিষয় আমাদের জন্য স্বস্তিকর নয়। আমরা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছি—রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের এমন একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি আছে। কিন্তু এ ঘটনায় শিবিরের ভেতরেও হত্যাকাণ্ড হতে পারে, এমন একটি নিরাপত্তাহীনতার বিষয় সামনে চলে এল।
প্রথম আলো: আপনি রোহিঙ্গা বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। সেই নিরিখেই বলছি, এ ঘটনার নেপথ্যের কারণ অনুমান করতে পারেন?
এমদাদুল ইসলাম: পুরো বিষয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তের মধ্যে দিয়ে উঠে আসবে। আমি কিছু অনুমানের কথা বলতে পারি। আমি তিনটি অনুমান করি। একটি হলো অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। সারা দুনিয়াতেই এই নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব আছে। মুহিবুল্লাহ উপরে উঠে যাচ্ছে, সেই জিঘাংসা থেকে কেউ এটা ঘটাতে পারে। দ্বিতীয়, মুহিবুল্লাহ একধরনের জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটানোর কাজে ছিলেন। যাঁরা এই জাতীয়তাবোধের উন্মেষের বাইরে ভিন্ন কিছু ভাবেন, তাঁরাও এটা করতে পারেন। অন্য কিছু বলতে আমি উগ্রতার কথা বলতে পারি। যেখানে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে, সেখানে উগ্রবাদ কিছু করতে পারে না। তৃতীয়, মহিবুল্লাহ প্রত্যাবাসনের পক্ষে ছিলেন। তিনি এ নিয়ে ভবিষ্যতে আরও সক্রিয় হতে পারতেন। যদি প্রত্যাবাসন হতো তাঁর অবস্থান হয়তো আরও উচ্চকিত হতো। তিনি মিয়ানমারে গিয়ে তাদের নেতা হয়ে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারতেন। যেসব দেশ রোহিঙ্গাদের এই প্রত্যাবাসন তৎপরতার পক্ষে নয়, তাদের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার বলি হতে পারেন মুহিবুল্লাহ। বাইরের কোনো দেশ এতে জড়িত থাকতে পারে, এটাও ধারণা করা যেতে পারে।
প্রথম আলো: রোহিঙ্গা শিবিরে কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতার কথা শোনা যায়। এসব কতটুকু সত্য?
এমদাদুল ইসলাম: এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। অনেক সময় পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে কথা হয়। সেসব শুনে মনে হয়, রোহিঙ্গা শিবিরে বোধ হয় কত সশস্ত্র দল আছে। এখানে কোনো বড় সশস্ত্র দল নেই। তাহলে তো ইনসার্জেন্সি বা গেরিলা তৎপরতা তৈরি হতো। রোহিঙ্গা শিবিরে এত দিনে কয়টি গুলির শব্দ শোনা গেছে? সশস্ত্র তৎপরতার কথা একেবারে ভুয়া। এখানে দু–একটি দেশি অস্ত্র নিয়ে কখনো শিবিরের মধ্যে কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসবই হয়েছে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে। কিন্তু কোনো সশস্ত্র দল সেখানে নেই। সশস্ত্র দল থাকলে পাঁচ বছরে পাঁচটা হলেও গুলি ফুটত। তা তো হয়নি।
প্রথম আলো: তাহলে শিবিরে ভেতরে মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড কীভাবে হলো?
এমদাদুল ইসলাম: এটা স্পষ্ট যে বাইরে থেকে অনুপ্রবেশকারীরা এ কাজ করেছে। তারা আবার পালিয়েও গেছে। এটাকে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতাই বলা যায়।
প্রথম আলো: শিবিরের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা বন্ধে কী করা যেতে পারে?
এমদাদুল ইসলাম: শিবিরের ভেতরে পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে। যদি নেতৃত্বের সংঘাতের জন্য এটা হয়, তবে কারা এটা করেছে তা খুঁজে বের করতে হবে। অভ্যন্তরীণ হানানহানির উসকানি কারা দিল তার সন্ধান করতে হবে। আর এটা বের করা জটিল বিষয় না। কারণ, রোহিঙ্গা শিবিরি হাজার মাইল এলাকাজুড়ে থাকা কোনো শিবির নয়। এটি নির্দিষ্ট একটি এলাকা। ঘটনা যেই করে থাকুক, তাকে বা তাদের খুঁজে বের করে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে।