দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দেওয়া হিসাব অনুযায়ী মুসা বিন শমসেরের সম্পদের পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। দুদকের সম্পদ বিবরণী নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রোববার আইনজীবীর মাধ্যমে সম্পদের হিসাব জমা দেন বিতর্কিত এই ব্যবসায়ী। দুদকের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র জানায়, মুসার জমা দেওয়া হিসাব অনুযায়ী সুইস ব্যাংকে তাঁর ১২ বিলিয়ন ডলার জমা রয়েছে, যা বাংলাদেশি টাকায় ৯৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসেবে)। সম্পদ বিবরণীতে তিনি জানিয়েছেন, সুইস ব্যাংকে তাঁর এ পরিমাণ অর্থ ‘ফ্রিজ’ (সাময়িক জব্দ) অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়াও সুইস ব্যাংকের ভল্টে ৯০ মিলিয়ন ডলার দামের (বাংলাদেশি প্রায় সাতশ কোটি টাকা) অলংকার জমা আছে। দেশে তাঁর সম্পদের মধ্যে গুলশান ও বনানীতে দুটো বাড়ি, সাভার ও গাজিপুরে ১২০০ বিঘা জমির কথাও বিবরণীতে তুলে ধরেছেন।
দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন আজ প্রথম আলোকে বলেন, মুসা বিন শমসের তাঁর সম্পদ বিবরণীতে যে হিসাব তুলে ধরেছেন তার আয়ের উৎস সঠিক কি না সেটা যাচাই করে দেখবেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এর মধ্যে মিথ্যা তথ্য রয়েছে কি না সেটাও যাচাই করা হবে।
সম্পদ বিবরণীতে সুইস ব্যাংকে জমা অর্থের বিষয়ে মুসা জানিয়েছেন, সুইস ব্যাংকে তার ১২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন অস্ত্র এবং ক্রুড ওয়েল ব্যবসা থেকে। তবে সুইস ব্যাংকে তাঁর যে হিসাবটি রয়েছে সেটি যৌথ অ্যাকাউন্ট বলে তিনি সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন। যৌথ অ্যাকাউন্টকারীদের সঙ্গে ‘ডিড অব এগ্রিমেন্ট’ থাকার কারণে ওই অ্যাকাউন্টে অন্যদের কি পরিমাণ অর্থ রয়েছে এবং ওই অ্যাকাউন্টের অংশীদার কতজন সে বিষয়ে উল্লেখ করা যাবে না বলে দুদককে জানিয়েছেন মুসা। এ কারণে সুইস ব্যাংকে কেবল তাঁর নিজের অংশের তথ্যই দুদকের কাছে জমা দিয়েছেন মুসা বিন শমসের।
দুদকের শীর্ষ পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা আজ প্রথম আলোকে বলেন, সম্পদ বিবরণীতে সুইস ব্যাংকে জমা থাকা অর্থের বিষয়টি উল্লেখ করায় দুদক নিশ্চিত হতে পেরেছে সুইস ব্যাংকে জমার থাকা অর্থের বিষয়ে। এত দিন দুদকের কাছে কোনো নিশ্চিত তথ্য ছিল না। তাঁরা বলেন, এর আগে সুইস ব্যাংকে তাঁর অর্থের কথা শোনা গেলেও এ পরিমাণ অর্থ তাঁর আদৌ আছে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল। অনেকে এমনও মন্তব্য করেছেন, নিজেকে আলোচনায় রাখতেই মুসার পক্ষ থেকে সুইস ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকার গল্প শোনানো হচ্ছে। সম্পদ বিবরণীতে সুইস ব্যাংকে জব্দকৃত অর্থের বিস্তারিত তথ্য দেওয়ায় এখন সন্দেহ অনেকটা দূর হয়েছে বলে দুদক কর্মকর্তারা মনে করেন।
দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, সম্পদ বিবরণীতে মুসা বিন শমসের সুইস ব্যাংকে ১২ বিলিয়ন ডলারের যে হিসাব দিয়েছেন তা দুদকের কাছে একটি দালিলিক তথ্য। দুদক এখন তা খতিয়ে দেখবে।
দুদকের কর্মকর্তারা জানান, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুদক এখন সুইস ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ অর্থ সম্পর্কে জানতে চাইবে। তাঁরা বলেন, দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে সুইস ব্যাংকের অর্থসহ যেসব সম্পদের হিসাব দিয়েছেন সেগুলোর বিষয়ে কোনো তথ্য গোপন বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকলে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৬ (২) ধারায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ধারার অপরাধ প্রমাণিত হলে তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
দুদকের সূত্রগুলো জানিয়েছে, সুইস ব্যাংকের লকারে মুসার ৯০ মিলিয়ন ডলার দামের যে অলংকারের কথা বলেছেন সেগুলো বিভিন্ন সময় কেনা হয়েছে এবং উপহার হিসেবে পাওয়া বলে উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি নিজের পরিবারের সদস্যদের কাছে থাকা অলংকারের তথ্যও তুলে ধরেছেন। তবে সেগুলোর দামের বিষয়টি সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়নি।
সম্পদ বিবরণীতে গাজীপুর ও সাভারে তাঁর নামে প্রায় ১২শ বিঘা সম্পত্তি রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন মুসা বিন শমসের। তাঁর দাবি, স্বাধীনতাত্তোরকালে ওইসব সম্পত্তি ক্রয় করলেও সেগুলো বর্তমানে তাঁর দখলে নেই। এসব সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য (এক বিঘা এক কোটি টাকা হিসেবে) প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি। অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে থাকায় এসব সম্পত্তির খাজনা পরিশোধ করে নামজারি করা সম্ভব হয়নি। এখন তিনি জমিগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন বলেও জানিয়েছেন মুসা। এ সব সম্পদের বাইরে ফরিদপুরে মুসার পৈত্রিক বাড়ি রয়েছে। এছাড়া গুলশানে ‘দ্য প্যালেস’ নামে প্রাসাদতুল্য বাড়িটি তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা চৌধুরীর নামে।
বাংলাদেশে নিজের ব্যবসায়িক কাজের তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে সম্পদ বিবরণীতে মুসা জানিয়েছেন, বনানীতে মেসার্স ড্যাটকো লিমিটেড নামে একটি জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তিনি। এর আরও কয়েকজন অংশীদার রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির নামে ঢাকায় দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তবে তাঁর নিজ নামে দেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কথা সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেননি এ ব্যবসায়ী।
সম্পদের হিসাব দিতে গত ১৯ মে মুসাকে নোটিশ পাঠায় দুদক। বিশেষ বাহক মারফত বনানীতে মুসার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ড্যাটকোতে এই নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশ জারির চার দিন পর দুদকের কাছে আরও সাত কর্মদিবস সময় চান তিনি।
এর আগে গত ৫ মে কমিশনের দৈনন্দিন সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মুসা বিন শমসেরের নামে সম্পদের হিসাব জানানোর নোটিশ জারির অনুমোদন দেন দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান।
গত বছরের জুন মাসে বিজনেস এশিয়া নামের একটি সাময়িকীর ঈদ সংখ্যায় মুসাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের সূত্রে একই বছরের ৩ নভেম্বর কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে মুসার সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। ওই সাময়িকীতে এই ব্যবসায়ীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তাঁর জীবনযাত্রা, আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর প্রায় ৪০ জন ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর বহর নিয়ে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সুইস ব্যাংকে জব্দকৃত তার অর্থ অবমুক্ত হলে এসব অর্থ পদ্মাসেতু নির্মাণসহ মানবকল্যাণে ব্যয় করবেন তিনি।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে মুসা দাবি করেন, বাংলাদেশ থেকে তাঁর কোনো অর্থই সুইস ব্যাংকে জমা হয়নি। ৪২ বছর বিদেশে বৈধভাবে ব্যবসার মাধ্যমেই তিনি ১২ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছেন, যা সুইস ব্যাংকে তাঁর নিজস্ব অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, মিসর, সিরিয়া ও পাকিস্তানসহ অনেক দেশের সরকারি প্রতিরক্ষা ক্রয় সংক্রান্ত পাওনা পরিশোধের অর্থ ওই সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সুইস ব্যাংকে তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে একটি দল অভিযোগটির অনুসন্ধান করছেন।