দীর্ঘদিন থেকে ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত মুজিবনগর ভ্রমণের। দীর্ঘদিন বলতে যখন থেকে ইতিহাস পড়তে ও বুঝতে শিখেছি, ঠিক তখন থেকেই। ফলে বিভাগ থেকে স্যার যখন মুজিব বর্ষ সামনে রেখে মুজিবনগরে শিক্ষাসফরে যাওয়ার কথা বললেন সাতপাঁচ কোনোকিছু না ভেবে এককথায়ই রাজি হয়ে যাই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, তথা মুজিব বর্ষে মুজিবনগরে শিক্ষাসফরে যাওয়ার ধারণা দেন মূলত ল অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ সেলিম তোহা স্যার। আর তা বাস্তবায়ন করেন বিভাগের প্রভাষক মো. মেহেদী হাসান স্যার।
২০ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাসফরে যাওয়ার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়। আমরা জানতে পারি মাত্র চার দিন আগে। হাতে সময় একদম কম থাকার ফলে একটু তাড়াহুড়া করেই সব প্ল্যান করতে হয়। মো. মেহেদী হাসান স্যার বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব ভাগ করে দেন। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সব প্রস্তুতি সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী আমরা গন্তব্যের পথে রওনা দিই সকাল আটটার দিকে। সবুজের বুক চিরে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা পিচকালো রাস্তা দিয়ে বাস ছুটে চলে মেহেরপুরের দিকে। বাসের মধ্যে নেচেগেয়ে আর হইহুল্লোড় করতে করতে আমরা মুজিবনগরে পৌঁছাই প্রায় ১১টার দিকে। মুজিবনগরে পৌঁছে আমরা চলে যাই ডাকবাংলোয়। ওখানে উঠে বিশ্রাম শেষে বের হই ইতিহাসের বাস্তব রূপ দেখতে।
মুজিবনগর গিয়ে দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে একাত্তরের বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত করতে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব ও পরিচালনায় ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
প্রথমে আমরা যাই মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে, যার স্থপতি তানভির করিম। এখানে আসার পর এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি স্মৃতিসৌধের আপাদমস্তক বর্ণনা করে আমাদের বোঝান।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নানান তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স। মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধের পর আমরা যাই এখানকার অন্যতম আকর্ষণ বাংলাদেশের মানচিত্র দেখতে। বলা যায়, এটি আমাদের যুদ্ধকালীন অবস্থার রূপক। এখানে তুলে ধরা হয়েছে দেশের কোথায়, কোন এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে, শরণার্থীরা কীভাবে সে সময় ভারত গিয়েছিলেন বা দেশ ছাড়েন। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে ভাগ করে দেখানো হয়েছে মানচিত্রে। এ ছাড়া মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের বাইরের অংশে ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ খণ্ডাংশ।
এরপর দলবেঁধে ভ্যান নিয়ে আমরা চলি সীমান্ত দেখতে। মুজিবনগরের খুব কাছেই ভারতীয় সীমান্ত। বাহারি পণ্যের অনেক দোকান ওখানে। বাংলাদেশ থেকে সোজা একটি রাস্তা চলে গেছে ভারতের দিকে। কাঁটাতারের ওপারে ভারত। বাংলাদেশের শেষ প্রান্তে এসে এ পাশ থেকে শুধু ভারতীয় অংশের গাছগুলোই দেখতে পেলাম। এটাই ছিল প্রথম সীমান্তভ্রমণ, তাই অনুভূতিটাও ছিল এককথায় অসাধারণ।
সীমান্ত থেকে মুজিবনগরে ফিরে পেটপূজা শেষে ছোটখাটো একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করি আমরা। কৌতুক পাঠ, নাচগানের পাশাপাশি র্যাম্প শো ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ। এ ছাড়া র্যাফল ড্রয়ের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে র্যাফল ড্রয়ের বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন বিভাগের সভাপতি সেলিম তোহা, সহযোগী অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান ও সহকারী অধ্যাপক আরমিন খাতুন এবং ল অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রভাষক মো. মেহেদী হাসান।
এ সময় সেলিম তোহা বলেন, ‘শিক্ষাসফরের সামগ্রিক অনুষ্ঠানগুলো আমি উপভোগ করেছি। আমি বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছি। আজ সবাই যেভাবে পারফর্ম করেছে, তাতে আমি মনে করি, এতে তাদের ভবিষ্যৎ সিঁড়ি পার হওয়া, মনোবল, সাহস এবং যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এটি একটি অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।’
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ অংশে শিক্ষাসফরে আসার পর সব ক্লান্তি আর অবসাদ ঝেড়ে ফেলে আমাদের মধ্যে যেন নতুন আবেগে দেশের প্রতি ভালোবাসা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার এক গভীর তৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছে। আর স্বপ্ন দেখছি, আগামী বছর হয়তো এভাবে আবার হারিয়ে যাব অপরূপ বাংলাদেশের কোনো এক কিনারায় নতুন কিছু জানতে।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া