মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়স তৃতীয়বারের মতো কমাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রথমবার বয়স ছিল ১৫ বছর, দ্বিতীয়বার ১৩ বছর করা হয়েছিল। এখন আরও আট মাস কমিয়ে ১২ বছর চার মাস করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সম্মানী ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) আগের সিদ্ধান্ত ছিল, ১৯৭১ সালে যাঁদের বয়স ১৫ বছরের কম ছিল, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির আবেদন করতে পারবেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠন এ বিষয়ে আপত্তি তোলে এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত জামুকার এক বৈঠকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যাঁদের বয়স ন্যূনতম ১৩ বছর ছিল, তাঁদের নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়। এখন তা আরও কমিয়ে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যাঁদের বয়স ১৩ বছর ছিল, তাঁদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জামুকা সূত্রে জানা গেছে, বয়স প্রমার্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বেশ কিছু আবেদন জমা পড়েছে। জামুকার ৩২তম সভায় এমন ১১টি আবেদন উপস্থাপন করা হলে প্রমার্জনের ক্ষমতা জামুকার চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে দেওয়া হয়। পাশাপাশি লাল মুক্তিবার্তায় নাম আছে এমন মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স প্রমার্জনের জন্য সাবেক চিফ হুইপ মো. আবদুস শহীদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের উপকমিটি করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স আরও কমিয়ে নির্ধারণ করার উদ্যোগের কথা স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা অত্যন্ত সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর বিষয়। তথাপি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নিরূপণের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা কারণে অনেকে বয়স কম দেখিয়েছিলেন। বিশেষ করে স্কুলে বয়স কমিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে। তবে যাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতের তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই বয়স প্রমার্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদনই বিবেচনায় নেওয়া হবে।
তবে জামুকার এক সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান বৈঠকে বলেছেন, ১৩ বছরের কম বয়সের একজন কিশোর পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে এমন ঘটনা হাতে গোনা। তাই ভারতের তালিকায় নাম থাকলেই কম বয়সের একজন কিশোরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা কতটা যৌক্তিক হবে, তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স যখন ১৫ বছর করা হয়েছিল, তখন ১৩ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম লালু, ১৪ বছর বয়সী তারামন বিবি ও আবু সালেকের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির কী হবে—এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এ ছাড়া কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য লালু মিয়া ১৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেন এবং বীর প্রতীক খেতাবও পান। অনেক মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁদের বয়স ১৫ বছরের বেশি থাকলেও এসএসসির সনদে বয়স কম দেখানো হয়েছে। এ কারণে ওই সভার সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়নি।
বয়স প্রমার্জনের জন্য জামুকায় করা আবেদনে মাগুরার আবদুস সাত্তার জানান, তাঁর সন্তান ৩৩তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ‘উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যয়নপত্র না পাওয়ায় তাঁর সন্তানের নিয়োগ স্থগিত হয়ে আছে। আবেদনে আবদুস সাত্তার জানান, যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ১৬ বছর ছিল। যুদ্ধের পর নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা বয়স কমিয়ে নিবন্ধন করেন। এতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তাঁর বয়স দাঁড়ায় ১২ বছর ২৫ দিন। এ অবস্থায় মানবিক দিক বিবেচনা করে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়নের অনুরোধ করেন আবদুস সাত্তার।
নওগাঁর ধামইরহাটের রাঙামাটি থেকে শারমিন আক্তার এক আবেদনে বলেছেন, ৩৩তম বিসিএসে ‘কারখানা পরিদর্শক পদে’ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তাঁর বাবা আবদুত দাইয়ানের বয়স ১৩ বছর থেকে ১ মাস ২৩ দিন কম হওয়ায় তিনি এখন প্রশাসনিক জটিলতায় পড়েছেন।
মনিরুল হক মুক্তিযোদ্ধা হলেও ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তাঁর বয়স ১৩ না হওয়ায় তিনি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পড়ছেন না। ওই দিন তাঁর বয়স ১১ বছর ২ মাস ২৬ দিন দেখানো আছে। জামুকার সভাপতিকে লেখা আবেদনে মনিরুল হক জানান, ‘আমার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত ৯ এপ্রিল তার ভর্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ অবস্থায় জামুকার সভায় বিষয়টি বিবেচনা করা না হলে আমার মেধাবী ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে।’
মুন্সিগঞ্জের আমির হোসেন, বগুড়ার মুস্তাফিজুর রহমান, ধামরাইয়ের নাজিম উদ্দিন, মানিকগঞ্জের সারোয়ার হোসেন, ঝালকাঠির নুরুল আলম, গাজীপুরের আবদুস সোবহান, যশোরের শহীদুল ইসলাম—তাঁরা সবাই বয়স ১৩ বছর থেকে দু-এক মাস কম থাকায় মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাননি। তাঁরা সবাই সন্তানদের চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে আবেদন করেছেন।
খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য এখন বীরশ্রেষ্ঠ ১২ হাজার, বীর উত্তম ১০ হাজার, বীর বিক্রম আট হাজার ও বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছয় হাজার টাকা মাসিক ভাতা পান। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা পান আট হাজার টাকা। জানুয়ারি থেকে এ ভাতা বাড়িয়ে যথাক্রমে ৩০ হাজার, ২৫ হাজার, ২০ হাজার, ১৫ হাজার ও ১০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব আছে।
এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এক বছর বাড়তি চাকরির সুবিধা পেয়ে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যরা চাকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কোটার সুযোগ পান। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও পোষ্যরা কোটার সুবিধা পান। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি আবাসন প্রকল্পে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা আছে।