পর্ব: ২৬

মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নৃশংস গণহত্যায় বেশির ভাগ শিকার হতেন নারীরা

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা গণকবর। এখানে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেওয়া হয়। ছবি: সংগৃহীত
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা গণকবর। এখানে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেওয়া হয়। ছবি: সংগৃহীত
>১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বিশ্বে নজিরবিহীন। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয় ৩০ লাখ মানুষ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এ–দেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড চলে। বধ্যভূমিতে অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ৬৪ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধারাবাহিকভাবে থাকবে প্রথম আলোর নাগরিক সংবাদে। আজ থাকছে কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

কুমিল্লা
চিতোষী খেয়াঘাট বধ্যভূমি
কুমিল্লার ডাকাতিয়া নদীর চিতোষী খেয়াঘাট বধ্যভূমিতে প্রতিদিন অনেক নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। স্থানীয় মানুষজন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে চলে এখানে হত্যাযজ্ঞ। তা এক দিনও বাদ পড়েনি।

ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের পুরো এলাকাটাকে পাকিস্তানি বাহিনী বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল। ২৫ মার্চের পর যেসব ক্যান্টনমেন্টে তারা সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট তার অন্যতম। সেই দিনগুলোতে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে হাজারো বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এখানে বাঙালি অফিসার, সৈনিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, গৃহবধূ, মসজিদের ইমাম কেউ রক্ষা পায়নি। স্বাধীনতার পর ময়নামতির গোটা এলাকার ঝোপঝাড়, ছোট ছোট টিলা, সমতল ভূমির কাশবনে, ডোবা বা নালার পাশে পাওয়া গেছে অসংখ্য নরকঙ্কাল। ব্রিগেড মসজিদের পশ্চিমে স্কোয়াশ রুমের পাশের গণকবর থেকে পাঁচ শতাধিক নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। রাজনীতিবিদ ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অমানুষিক নির্যাতনের পর এই ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টেই হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক পূর্বদেশ’–এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে মোট ১২টি গণসমাধি খনন করে এ পর্যন্ত সাত হাজার নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে।’

লাকসাম সিগারেট ফ্যাক্টরি বধ্যভূমি
কুমিল্লার লাকসাম সিগারেট ফ্যাক্টরিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চালায় বর্বরতা, নৃশংসতা, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড। এই ফ্যাক্টরির বিভিন্ন কোণে, কক্ষে ও কোঠায়, সেলে ও ছাদে অত্যাচার, নারী ধর্ষণ এবং নির্বিচারে গণহত্যা করে। গ্রামগঞ্জ ও লাকসাম জংশনে অপেক্ষমাণ ট্রেন থেকে বিভিন্ন বয়সের নিরীহ পুরুষ ও নারী যাত্রীকে ধরে নিয়ে এখানে বন্দী রেখে নির্যাতন করে এবং পরে তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। অনেক মেয়েই এই নৃশংস যৌন নির্যাতনে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। অনেক নারী সম্ভ্রমহানির পরিপ্রেক্ষিতে আত্মহত্যাও করেন। অনেক নারীকে গ্রাম থেকে ধরে এনে উলঙ্গ করে কারখানার রেলিংবিহীন ছাদে উঠিয়ে দুহাত ওপরে তুলে সারা দিন হাঁটতে বাধ্য করা হতো। নির্যাতনের কারণে অনেকে মৃত্যুবরণ করতেন। আর যাঁরা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তেন, তাঁদের মরদেহ কারখানার বিভিন্ন কোণে পুঁতে ফেলা হতো। এই ফ্যাক্টরির মধ্যে একটি পুকুর রয়েছে। এই পুকুরের পাড়ে রয়েছে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা প্রভৃতি গাছ। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ওই সব গাছের নিচে আগাছায় ভরা জমিটুকু খুঁড়লে বের হয়ে পড়বে অসংখ্য ভাইবোনের অজস্র নরকঙ্কাল। পুকুরের পূর্ব পাড়ে একটি ভরাট গর্তের চিহ্ন দেখিয়ে জানালেন যে একটি জীবন্ত লোককে হাত-পা বেঁধে এই গর্তে ফেলে দিয়ে মাটিচাপা দিতে তিনি দেখেছেন।

লাকসাম রেলস্টেশন বধ্যভূমি
লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে কেবিন বরাবর পূর্ব দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তৈরি বাংকারে উত্তর-দক্ষিণে এই বধ্যভূমিটির অবস্থান। কুমিল্লা জেলার দক্ষিণাংশ, বৃহত্তর নোয়াখালী এবং চাঁদপুরের হতভাগ্য বাঙালি যুবক-যুবতী, বৃদ্ধা, শিশুদের এখানে এনে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হতো। দেড়-দুই মিটার গভীর গর্ত করে তার পাশে জীবিত মানুষদের হাত-পা বেঁধে গুলি করা হতো। এরপর লাথি দিয়ে ফেলা হতো গর্তে। গুলি খাওয়ার পরেও যারা জীবিত থাকতেন, তাঁদেরও মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হতো। লাকসাম রেলওয়ের সাবেক মালী শ্রীধাম চন্দ্র দাস বলেন, তিনি নিজের হাতে ১৪–১৫ জনকে মাটিচাপা দিয়েছেন। প্রাণভয়ে বাধ্য হয়ে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর কথায় কবর খুঁড়তেন এবং মৃত ব্যক্তিদের মাটিচাপা দিতেন। এসব লাশের মধ্যে প্রচুর নারীর লাশও ছিল।

মুদাফফরগঞ্জ বধ্যভূমি
কুমিল্লার মুদাফফরগঞ্জ একদল রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী ৩৭ জন লোককে হত্যা করে। শুধু হত্যা করেই থেমে থাকেনি, তারা একটি বাড়ি থেকে চারজন বালিকাকে ধরে নিয়ে গণধর্ষণ করে। তিন-চার দিন পর তাঁদের মৃতদেহ পাশের একটি খালে ভাসতে দেখা যায়।

হাড়ং গণকবর
কুমিল্লার চান্দিনার হাড়ং গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাড়ির পাশে তাঁর এক খণ্ড জমি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা গণকবর হিসেবে ব্যবহার করত। হত্যার পর এখানে মাটিচাপা দিত। আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মাকেও এখানে হত্যার পর পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা এখানে মাটিচাপা দেয়। জানা যায়, ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে গণকবর দেওয়া হয়।

আমড়াতলি গণকবর
১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার আমড়াতলির ধনঞ্জয় খন্দকার বাড়ির ২৬ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। খন্দকারবাড়ি ছাড়াও অন্যান্য স্থানে হত্যা করা হয় আরও ১০ জনকে। হত্যার পর আমড়াতলিতে গণকবর দেওয়া হয়।

বেতিয়ারা গণকবর
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা গণকবর। এখানে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদীঘির বেতিয়ারা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে এই বীর মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হন। তাঁদের নাম হচ্ছে নিজামউদ্দিন আজাদ, আওলাদ হোসেন, সিরাজুম মুনীর জাহাঙ্গীর, জহিরুল হক ভূঁইয়া (দুদু মিয়া), বশিরুল ইসলাম, মো. শহীদুল্লাহ সাউদ, আবদুল কাইয়ুম, মোহাম্মাদ সফিউল্লাহ ও আবদুল কাদের। জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৭৮ জনের একটি গেরিলা দল আগরতলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। দলটি ১০ নভেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বেতিয়ারা এলাকায় জমায়েত হয়। ১১ নভেম্বর ভোরে যুদ্ধে শহীদ হন ৯ জন। পরের দিন শহীদদের মরদেহ বেতিয়ারার ধানখেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। সাত দিন পর স্থানীয় লোকজন ধানখেত থেকে তাঁদের গলিত লাশ উদ্ধার করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে একটি গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দেন। পরে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়।

এ ছাড়া নারায়ণপুর গণকবর, দক্ষিণ বাজার গণকবর, রূপবান কন্যার মুড়া বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য।

এখানেই শুয়ে আছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা। ছবি: সংগৃহীত

চাঁদপুর
রেলস্টেশন বধ্যভূমি
চাঁদপুর রেলস্টেশন এলাকার বধ্যভূমিতে ছিল একটি কসাইখানা। রেলস্টেশনের অফিসগুলো এবং রেস্টহাউসেও পাকিস্তানি ও তাদের দোসররা ক্যাম্প স্থাপন করে। স্টেশনের ওয়েটিং রুমকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। এখানে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করে। রেলের ডোম ছনুয়া ও গয়াকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে এসব লাশ সরাতে বাধ্য করা হতো।

কাকৈয়া ব্রিজ বধ্যভূমি
চাঁদপুরের চিতোষী স্টেশনের অনতিদূরেই কাকৈয়া ব্রিজের বধ্যভূমিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। মানুষজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে আসে এই বধ্যভূমিতে। তারপর তাদের হত্যা করে লাশ ডাকাতিয়া নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

মাকিমাবাদ জলাভূমি বধ্যভূমি
স্বাধীনতার পর হাজীগঞ্জের মাকিমাবাদের জলাভূমি বধ্যভূমিতে প্রায় তিন শ মাথার খুলি এবং মানুষের হাড় বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

হামিদা জুট মিল বধ্যভূমি
হাজীগঞ্জে হামিদা জুট মিলকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনে তিন হাজার বাঙালিকে হত্যা করে। জানা যায়, নির্যাতন করার পর হাত-পা একসঙ্গে বেঁধে মৃত বা অর্ধমৃত অবস্থায় ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দিত।

নূরিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয় বধ্যভূমি
চাঁদপুরের পুরোনো বাজারে নূরিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে ছিল আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প। এখান থেকে তারা চাঁদপুরের পুরান বাজার এলাকায় হত্যা, লুট, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। গণহত্যা ও অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করা হয়। রেল, লঞ্চ, রাস্তাঘাট, নৌকাগুলোতে ও বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে হানা দিয়ে হানাদারেরা বাঙালিদের ধরে এনে এই ক্যাম্পে নির্যাতনের পর হত্যা করত।

এ ছাড়া চাঁদপুরের খোদাই বিল বধ্যভূমি, নাসিরকোর্ট উচ্চবিদ্যালয় বধ্যভূমি, মতলব ডিগ্রি কলেজের মাঠ বধ্যভূমি, চিশতী বাজার বধ্যভূমি, নরেনপুর বধ্যভূমি, ডাকবাংলো বধ্যভূমি, রহিমানগর বধ্যভূমি, বঙ্গবন্ধু কলেজ মাঠ বধ্যভূমি, হাইমচর বাজার বধ্যভূমি রয়েছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে হত্যাকাণ্ড চালায়, তা বিশ্বে নজিরবিহীন। ছবি: সংগৃহীত

ব্রাহ্মণবাড়িয়া
আশুগঞ্জ সাইলো বধ্যভূমি
আশুগঞ্জ সাইলোর অনেক বড় টর্চার ক্যাম্প ছিল। এখানে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ঢাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য নারী–পুরুষকে সাইলোতে ধরে এনে নির্যাতন করত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বড় অফিসারদের মনোরঞ্জনের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের আশুগঞ্জ সাইলোতে নিয়ে আসত। তাঁদের ধর্ষণ ও হত্যার পর মেঘনা নদীতে ফেলা দেওয়া হতো। রাজাকাররা এলাকার বিত্তশালী মানুষদের সাইলোতে আটক করে নির্যাতন চালিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ বধ্যভূমি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রয়েছে অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমি। এগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণের বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যার পর গণকবর দেওয়া হয়।

ওয়াপদা বধ্যভূমি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে ওয়াপদা বধ্যভূমি ছিল কুখ্যাত। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরীহ ও নিরস্ত্র লোকজনকে এখানে এনে হাত-পা-চোখ বেঁধে হত্যা করা হতো।

দাতিয়ারা বধ্যভূমি
ব্রাহ্মণবাড়িয়া দাতিয়ারা বধ্যভূমিতে বহু লোককে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর স্থানীয় লোকজন জানান, কোনো কোনো গর্ত থেকে ১৫–২০ জন লোকের কঙ্কাল পাওয়া গেছে।

কুরুলিয়া খাল বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের শিক্ষক, চিকিৎসক, উকিল, রাজনৈতিক কর্মীসহ এমন ৪০ জন বুদ্ধিজীবীকে ডেকে নিয়ে রাতের অন্ধকারের কুরুলিয়া খালের পাড়ে গুলি করে হত্যা করে।

পৈরতলা বধ্যভূমি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা গ্রামে ঈদুল ফিতরের দিন সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে পাঞ্জাবি সেনারা এলাকাটিকে ঘিরে ফেলে। এরপর সেখানে কারফিউ দেওয়া হয়। এরপর স্থানীয় ছয়-সাতজনকে নিয়ে তিন বড় বড় গর্ত খোঁড়ে। গর্ত খোঁড়া শেষ হলে তাঁদের সবাইকে হত্যা করে গর্তে ফেলে দেওয়া হয়। সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি বড় বাসভর্তি মুক্তিকামী বাঙালিদের সেখানে নিয়ে আসা হয়। এরপর আধা ঘণ্টা ধরে চলে গুলিবর্ষণ, মানুষের চিৎকার, হাহাকার, বাঁচার করুণ আকুতি। অনেককে জীবন্ত অবস্থায় মাটিচাপা দেওয়া হয়। রাত দশটার পর এক দুঃসাহসী প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনাস্থলে এসে তিনটি বড় বড় গর্ত মাটিচাপা অবস্থায় দেখতে পান। বেশ কিছু দূরে তিনি একজন আহত লোককে খাদে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখে টেনে তোলেন। আহত লোকটি জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার থেকে কয়েক শ বন্দীকে ধরে এনে এখানে গুলি করে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। অনেকের আঘাত গুরুতর ছিল না, কিন্তু তাঁদের সবাইকে জীবন্ত মাটিচাপা দেওয়া হয়।

গঙ্গাসাগর দীঘি বধ্যভূমি
আখাউড়া সীমান্তের নিকটবর্তী গঙ্গাসাগর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরো ৮ মাস মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর যুদ্ধ চলত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার দোসররা তান মান্দাইল ও বাঙালিয়া গ্রাম দুটিতে আক্রমণে করে অনেককে ধরে এনে এখানে নির্যাতন করে। এর মধ্যে ৩২ জনকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয়। এ ৩২ জনকে হত্যা করে গঙ্গাসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ের তিনটি গণকবরে পুঁতে রাখে। এখানে শহীদ হন আবদুল গনি, রিয়াজ উদ্দিন, সাধন মিয়া, মুসলিম মিয়া, শ্যামল মিয়া প্রমুখ।

শাহবাজপুর গণকবর
১৯৭১ সালের জুন মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের শাহবাজপুরের গণকবরে ৯টি নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এই নয়জনের মধ্যে পাঁচটি পুরুষের ও চারটি নারীর লাশ ছিল। এই নয়জন শহীদ হলেন বৈকুণ্ঠ নাথ, মহেশ্বরী দাস, তারিণী দাস, কৌশল্য দাসী, জগৎ মোহন দাস, প্রহ্লাদ দাস, শচীন্দ্রনাথ দাস, মুক্তময়ী দাস ও বিধুমুখী দেবী।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ’৭১-এর গণহত্যা ’৭১, আবু সাঈদ সম্পাদিত; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, সুকুমার বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধ কোষ, প্রথম, দ্বিতীয় খণ্ড, মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, দৈনিক পূর্বদেশ, ২২ জানুয়ারি ১৯৭২, যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, ডা. এম এ হাসান, দৈনিক পূর্বদেশ, ২৯ জানুয়ারি, ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১০ মার্চ ১৯৭২ দৈনিক বাংলা, ২১ ও ২৬ জানুয়ারি এবং ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক পূর্বদেশ, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক প্রথম আলো, ২৩ অক্টোবর ১৯৯৯, মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড, আবু মোহাম্মদ দেলয়ার হোসেন সম্পাদিত, ১১ নভেম্বর ২০১৪, প্রথম আলো

*এই তিন এলাকার গণহত্যা, গণকবর কিংবা বধ্যভূমিসংক্রান্ত আরও যদি খবর থাকে, অনুগ্রহ করে মেইলে জানাবেন।

আবু সাঈদ: কবি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
abusayedone@gmail.com