বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রী সৈন্যের অবতরণ ও পাকিস্তানি বাহিনীর নাটকীয় আত্মসমর্পন এই যুদ্ধের মোড় ফেরানো ঘটনা। মাত্র পাঁচদিন পর, ১৬ ডিসেম্বর, ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী সদলবলে ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পন করে, অথচ ঢাকা দখলের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তখন পর্যন্ত চুড়ান্ত হয়নি। এত দ্রুত যে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে, সে বিবেচনাও যৌথ কমান্ডের সামনে ছিল না। অবস্থা বদলে দিল ‘টাঙ্গাইল এয়ারড্রপ’ নামে পরিচিত ১১ ডিসেম্বরের সে ঘটনা। ভারতীয় সেনা বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর কৌশলগত পরিকল্পনার নিখুঁত বাস্তবায়ন, পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বুদ্ধিতা ও কিছুটা নির্ভেজাল সৌভাগ্য, এই তিন ঘটনার সম্মিলনে সমর ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকল টাঙ্গাইল। প্রামাণিক তথ্যের ভিত্তিতে এখানে সে ঘটনার পুননির্মাণ করা হল। সাথে থাকল সামান্য কল্পনার ছোঁয়া।
শনিবার, শীতের সকাল। আকাশে এক ফোটা মেঘের আভাস নেই। গত এক সপ্তাহ ধরেই পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধের উত্তাপ বাড়ছে। ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে হাতে হাতে মিলিয়ে যুদ্ধ করছে মুক্তি বাহিনী। টাঙ্গাইল এলাকায় সামরিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার কাদের সিদ্দিকী, তিনি প্রতি মুহুর্তে কৌশলগত সমন্বয় রক্ষা করে চলেছেন ভারতীয় সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে। দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি মুক্তি বাহিনীর পরিচিত, পাকিস্তানি সেনা অবস্থান ও গতিবিধি তাদের নখদর্পনে। তারাই ভারতীয় বাহিনীকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলেছে।
ইতিমধ্যে উভয়পক্ষের রণকৌশল পরিষ্কার হয়ে এসেছে। পাক বাহিনীর চুড়ান্ত লক্ষ্য রাজধানী ঢাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। চীন ও আমেরিকার সাহায্য এসে পৌছাচ্ছে, এই প্রতিশ্রুতি ইসলামাবাদ থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তারা পেয়েছে। এই অবস্থায় যেকোন মূল্যে যৌথ বাহিনীর ঢাকা আগমন বিলম্বিত করা তাদের মুখ্য রণকৌশল। তারা জানে সেখানে ঢাকা পৌঁছাতে হলে ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনীকে দেশের তিন প্রধান নদী–পদ্মা, মেঘনা, ও যমুনা–অতিক্রম করে এগুতে হবে। পাকিস্তান বাহিনীর চেষ্টা এই তিন নদীপথের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা। পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল নিয়াজীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সাতটি ব্রিগেড, যার প্রতিটির সদস্য সংখ্যা পাঁচ হাজার। এই মুহুর্তে এদের প্রধান দায়িত্ব, দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রধান শহর গুলো আগলে রাখা। নিয়াজী তাঁর এই রণকৌশলের নাম দিয়েছেন ‘ফোর্ট্রেস পলিসি’ বা দূর্গ নীতি। প্রতিটি শহর দূর্গের মত কাজ করবে, শত্রু বাহিনীকে কোনক্রমেই তাদের অতিক্রম করে এগুতে দেওয়া হবে না। কোণঠাসা হয়ে পড়লে তারা পরিকল্পিত ভাবে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবে। ঢাকা হয়ে পড়বে প্রধান দূর্গ। যতক্ষণ চীন অথবা মার্কিন সাহায্য না এসে পৌছাচ্ছে ততক্ষণ সে দূর্গ তারা আগলে রাখবে।
অন্যদিকে যৌথ বাহিনীর লক্ষ্য এই তিন নদী ঘিরে পাকিস্তানি বহরকে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ক্ষমতাহীন করে ফেলা ও আত্মসমর্পনে বাধ্য করা। ভারতীয় হামলায় ইতিমধ্যেই পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানের বিমান বহর ধ্বংস হয়েছে। এই সেক্টরে তাদের কখনোই কোন উল্লেখযোগ্য নৌ শক্তি ছিল না। দেশের উভয় অংশের মধ্যে সরাসরি বিমান যোগাযোগ সীমিত হয়ে এসেছে, ফলে পশ্চিম অংশ থেকে নতুন সরবরাহের সম্ভাবনাও কার্যত শূন্য। কোণঠাসা পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাফেরা অচল করার লক্ষ্যে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা ইতিমধ্যেই দেশের সেতু ব্যবস্থায় বড় রকম আঘাত হেনেছে। ফলে নিজেদের প্রতিপক্ষের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু পরিণত না করে পাকিস্তানিদের পক্ষে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা অথবা যৌথ বাহিনীর ওপর অর্থপূর্ণ পাল্টা হামলা চালানো পাকিস্তানিদের কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সকাল থেকেই নিজেকে চাঙ্গা রাখতে সচেষ্ট ছিলেন নূরুন নবী। শীত শীত ভাবটা বেশ জেঁকে বসেছে, গায়ে পুরানো তাঁতের চাদরখানা সেঁটে ধরেও বাগ মানানো যাচ্ছে না। মনটি বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল, আগের দিন একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত অবস্থায় তাঁদের ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর আশু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সবচেয়ে জরুরী। অন্য আরেক চিন্তাও তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি জানেন আজ বড় একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে, যার ফলে এই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে পারে। হাতে গোণা যে ক’জন একথা জানতেন তিনি তাঁদের অন্যতম। কাদের সিদিকীর ঘনিষ্ঠতম সহকারীদের একজন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকস ছাত্র, যুদ্ধের শুরু থেকেই কোন রকম সামরিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও কাদেরিয়া বাহিনীর এই দুর্ধষ কমান্ডারের ডান হাত হয়ে উঠেছেন। প্রথমদিকে তাঁর দায়িত্ব ছিল অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের সমন্বয়, পরে প্রতিরোধ যুদ্ধ প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওপর দায়িত্ব বর্তায় ভারতীয় সেনা কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ ও তাদের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ। কাদের সিদিকী ঠাট্টা করে বলতেন, নূরুন নবী আমার ‘ফরেন মিনিস্টার’।
ঘনঘন আকাশের দিকে চোখ রাখছিলেন তিনি। নির্মেঘ আকাশ। তিনি আশায় আছেন কখন এই আকাশেই ভারতীয় ছত্রী সেনাদের আগমণ ঘটবে। ছত্রী সেনা ব্যাপারটা অন্য অনেকের মত তাঁর কাছেও কিছুটা ধোঁয়াটে। ফিল্মে দেখেছেন, কিন্তু নিজের চোখের সামনে আকাশ থেকে বেলুনের মত একের পর এক সৈন্য হাওয়ায় উড়ে এসে মাটিতে পা রাখবে, সেকথা চিন্তা করে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল।
এক মাস আগে, ৭ নভেম্বর মেঘালয়ের রাজধানী তুরার কাছে ভারতীয় বাহিনীর কমুনিকেশন্স কোর এর দপ্তরে পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছ থেকেই তিনি জেনে এসেছেন অতি সত্বর টাঙ্গাইলে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে ভারতীয় ছত্রী সেনা অবতরণ করবে। সে সাক্ষাতের সময় তাদের সঙ্গে আরো দুজন ভারতীয় অফিসার উপস্থিত ছিলেন–ব্রিগেডিয়ার সনৎ সিং এবং মেজর জেনারেল গিল।
মুক্তিযোদ্ধারা এই অঞ্চল নিজেদের হাতের তালুর উলটো পিঠের মত চেনেন। তাদের ওপরেই দায়িত্ব ছিল স্থানগুলি নির্ধারিত করা, অবতরণ যাতে নির্বিঘ্ন হয় তা নিশ্চিত করা। ভারতীয় জেনারেলরা জানালেন, মুক্তি বাহিনী সদস্যরাই ঠিক করবে কোথায় ছত্রী সেনা অবতরণ করবে। কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনা করে মোট তিনটি স্থান বাছাই হয়েছিল, তিনটিই টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়ক বরাবরঃ ঘাটাইল থানার পশ্চিমে গৌরাঙ্গির ঘাট, কালিহাতী থানার পশ্চিমে বাংড়া-শোলাফুরার লম্বা মাঠ, ও ইছাপুর-সাহদেবপুরের দক্ষিণে পাঠানের মাঠ। এই ছত্রী অবতরণের সামরিক উদ্দেশ্য পাকিস্তানি প্রতিরোধ এড়িয়ে দ্রুত মেঘনা নদীর ওপর পুংলি সেতু দখল। এই সেতু দখল করা গেলে একদিকে নদীর অপর পাড়ে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে ঢাকা-টঙ্গি সড়কপথ ধরে নির্বিঘ্নে মিরপুর সেতু ধরে দ্রুত ঢাকার পথে এগুনো যাবে।
দীর্ঘদেহী শিখ জেনারেল ২২-বছর বয়সের এই অপরিচিত যুবকের কাছে ভারতীয় বাহিনীর সবচেয়ে গোপনীয় এমন একটি তথ্য দেওয়ার আগে বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন, ইয়াং ম্যান, প্রটেক্ট দিস সিক্রেট উইথ ইয়োর লাইফ। একমাত্র কাদের সিদ্দিকী ছাড়া এই খবর যেন আর কেউ না জানতে পারে। এই খবর ফাঁস হলে তাদের যুদ্ধ পরিকল্পনায় বড় রকমের আঘাত আসবে, বিলম্বিত হবে ঢাকা দখল।
সাক্ষ্যভাষ্য: রাত প্রায় দুটর দিকে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কাদের (সিদ্দিকী) ভাইকে ফিসফিস করে বললাম যে কিছু গোপনীয় বার্তা আছে। কাদের ভাই বললেন, চল, ঘরের বাইরে যাই। অন্ধকার রাতে আমরা ঘরের বাইরে এগুতেই প্রহরারত রক্ষী আমাদের পথরোধ করে বলল, স্যার, সঙ্গে আসব কি? কাদের ভাই বললেন, না, আসতে হবে না। আমরা উঠোনের অপরপ্রান্তে বেঞ্চে নিচুস্বরে কথা শুরু করলাম। … অতসত্বর মধুপুর-টাইঙ্গাইল সড়কের কাছাকাছি ভারতীয় ছত্রীসেনা অবতরণের অর্থ কী তা আমাদের দুজনের বুঝতে আর বাকি রইল না। বিজয়ের সংকেত পেয়ে আমরা আনন্দে দুজনে পরস্পরকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলাম।
—আমার একাত্তর আমার যুদ্ধ, ড. নূরুন নবী, আগামী প্রকাশনী, ২০০৪, পৃ. ১৫৮-১৫৯
বোতলে এখনো কয়েক ফোটা হুইস্কি অবশিষ্ট, জেনারেল নিয়াজী দু’হাতে বোতলখানা তুলে ধরে শেষ ফোটা ঢালবার চেষ্টা করলেন। না, নেই। মনটা আগে থেকেই খিচড়ে ছিল। ফ্রন্ট থেকে একের পর দুঃসংবাদ আসছে। যশোর ও ঝিনাইদহের পতন হয়েছে। লোকবল কম, বিমান থেকে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেই। আত্মরক্ষার তাগিদে যশোরকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিয়ে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খুলনায় চলে এসেছেন। চৌগাছা-ঝিনাইদহ সড়কের দখল মুক্তি বাহিনীর হাতে চলে গেছে, তাদের তৈরি বেড় ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে ৩৭ ব্রিগেডের সদস্যরা যে যেভাবে পারে মধুমতির পেছন দিকে পালিয়ে গেছে। ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনীর উপর্যুপরি হামলায় ৯ ডিভিশন ভাঙ্গনের মুখে। ১৬ ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার মনোয়ার যে ব্রিগেডটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তাদেরকে ঢাকায় ফিরে আসতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নদী পেরুনোর কোন পথ ছিল না, সব নৌকাগুলো মুক্তি বাহিনী হয় সরিয়ে ফেলে, নয়ত ডুবিয়ে দেয়। ওদিকে সিলেটে পাকিস্তানি গ্যারিসন সদর দপ্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ভীত-সন্ত্রস্ত ১৪ ডিভিশনের সদস্যরা ব্রাম্মণবাড়িয়া ছেড়ে এলে যৌথ বাহিনী ভৈরব দখল করে নিয়েছে। ১৬ ডিভিশন নিয়ে তাঁর অনেক আশা-ভরসা ছিল। মুক্তি বাহিনী পীরগঞ্জের কাছে রংপুর-বগড়া সড়ক কেটে ফেলায় তাদেরও আর সামনে এগুবার পথ থাকল না।
নিয়াজী তবুও আশা হারাননি। ইসলামাবাদ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে অতি সত্বর দ্বিমুখী সাহায্য এসে পৌছাচ্ছে, একদিকে চীন অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছেন, যেভাবে পার ঢাকা ঠেকিয়ে রাখো। বাকিটা ‘ওরাই’ করবে। নিয়াজী হিসাবে করে রেখেছেন ঢাকায় প্রবেশ করতে হলে ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনীকে জামালপুর ও ময়মনসিংহে অবস্থানরত ৩০ পাঞ্জাব ও ৩১ বালুচ ব্যাটালিয়নকে পরাস্ত করতে হবে। কাজটা অসম্ভব নয়, কিন্তু সেজন্য শত্রুদের মেঘনা পেরুতে হবে। যতক্ষণ পুংলি সেতু তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, শত্রুর পক্ষে মেঘনা পেরুনো অসম্ভব।
মাথা চুলকালেন নিয়াজী। একসময় মাথাভর্তি চুল ছিল, এখন তা কমতির দিকে। টেবিলে রাখা সর্বশেষ গোয়েন্দা রিপোর্টটি চোখের সামনে তুলে ধরলেন। না, চোখজোড়াও যাবার জোগাড়। টেবিলে বিছানো মানচিত্রে শত্রু বাহিনীর অবস্থান পরীক্ষা করে বুঝতে চাইলেন তার এক সময়ের বন্ধু জেনারেল জাগজিৎ সিং আরোরা ঠিক কী করতে চলেছে। ঢাকা দখল যদি তাঁর লক্ষ্য হয় তাহলে সবচেয়ে সহজ পথ ময়মনসিং-টাঙ্গাইল-ঢাকা সেক্টর ধরে আগানো। কিন্তু ভারী সেনা মোতায়েনের বদলে অরোরা এখানে মোটে দুটি নিয়মিত ইনফান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন মোতায়েন করেছে। অন্য কোন ফন্দি নেই তো? এখানে কাদের সিদিকীর নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী বড় ধরণের সাফল্য পেয়েছে। অরোরা হয়ত কাদেরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কিছু একটা করতে চাইছে। কিন্তু সেটা কি?
সাক্ষ্যভাষ্য: ভারতীয় বাহিনী যদি তাদের মূল লক্ষ্য ঢাকা দখল নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে ময়মনসিং-টাঙ্গাইল সেক্টর, যা ১০১ কমুনিকেশন্স জোন নামে পরিচিত, সেখানে অতিরিক্ত শক্তি নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু ভারতের দুর্বল নেতৃত্ব এতটা সতর্ক ছিল যে তারা কামালপুর ফাঁড়ি আক্রমণে সাহস পায়নি। অথচ ভারতীয়দের এক ব্রিগেড সেনা ও মুক্তি বাহিনীর এক ব্রিগেড ঝাপিয়ে পড়লে তা দখল কোন সমস্যাই হত না। আমার নির্দেশে আত্মসমর্পনে সম্মত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের এই ফাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
—দ্য বিট্রেয়াল অফ ইস্ট পাকিস্তান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, ইউপিএল, ১৯৯৮, পৃ. ২১৬–২১৭
সাক্ষ্যভাষ্য: পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার অপারেশনগত ধারণার পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে লেঃ জেঃ নিয়াজী বিপর্যয়ের বীজ বপন করেছিলেন। তিনি যে পরিকল্পনা বিকশিত করেছিলেন তা বিদ্যমান অপারেশনাল পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ভারতীয় আক্রমণ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই পরিকল্পনাটির দুর্বলতা প্রকাশিত হয়ে পড়তে শুরু করেছিল। … বিস্তৃত ফ্রন্ট, দুর্বল ও পাতলা প্রতিরক্ষা এবং সংখ্যায় ও গোলাবারুদের ক্ষমতায় শত্রুর সর্বব্যাপী শ্রেষ্ঠত্বের কারণে দুর্গের মাধ্যমে দৃঢ় ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষার ধারণা সফল হতে পারেনি। এটা কেবল বিশৃংখল পশ্চাদপসরণের কারণ ঘটিয়েছে।
—বাংলাদেশের জন্ম, রাও ফরমান আলী খান, ইউপিএল, ১৯৯৬, পৃ. ১৪৩)
ভারতীয় বিমান বাহিনীর তরুণ অফিসার ক্যাপ্টেন নির্ভয় শর্মা কোলকাতার দমদম বিমান ঘাঁটি থেকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মাত্র একদিন আগে তারা বশিরহাট সেনা ছাউনি থেকে কোলকাতায় এসে পৌছেছেন। অভিযানটির নেতৃত্বে রয়েছেন কর্নেল কুলবন্ত সিং পান্নু। সাহসী ও বুদ্ধিমান কমান্ডার হিসাবে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় প্যারাট্রুপারদের শেষ ব্রিফিঙয়ে তিনি এই অভিযানের গুরুত্ব বুঝিয়ে বলেছেন। ‘তোমাদের কাজ হবে মেঘনার ওপর পুংলি সেতু দখল। যৌথ বাহিনীর হাতে বেধড়ক মার খেয়ে উত্তর দিক থেকে ৯৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে আসছে। যাতে সেতু পার হয়ে ঢাকা দিকে তারা না যেতে পারে, তা নিশ্চিত করাই তোমাদের কাজ। পাকিদের নিরস্ত্র করার পর মানিকগঞ্জ-সড়ক পথে তোমরা মারাঠা লাইট ইনফ্যান্তড়ি সাথে যুক্ত হয়ে ঢাকা প্রবেশ করবে।’
কর্নেল পান্নুর কথা শুনে কোন কোন প্যারাট্রুপার ‘হুররা’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল, নির্ভয় শর্মা তাদের একজন। পান্নু কপট ক্রোধে কটমট চোখে তাকিয়ে নিজেই হেসে দিলেন। মুখে বললেন, ইজি বয়েস, ইজি। এরপর ঠিক কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত মোট ৭০০ ছত্রী সেনা অবতরণ করবে, তার নকশা এঁকে দেখালেন তিনি। কর্নেল পান্নু জানালেন, তিনি নিশ্চিত করেছেন যে এলাকায় তারা অবতরণ করবে, তা সম্পূর্ণ বাঙালি মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। শুধু তাই নয়, কাদের সিদ্দিকী নামে একজন প্রাক্তন পাকিস্তানি সেনা অফিসারের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী মুক্তি বাহিনী গত কয়েক মাস ধরে পুরো এলাকাটি নিজেদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে।
নির্ভয় শর্মা পকেটে রাখা এয়ার ড্রপের ম্যাপটি শেষবারের মত চোখ বুলিয়ে নিলেন। মোট চার কিলোমিটার বিস্তির্ণ এলাকায় তিনটি ক্ষেত্র। একটি হাই ওয়ের পাশে, প্রধানত গ্রাম ও ফসলের মাঠের ওপর তাদের অবতরণ করতে হবে। ছত্রী সেনাদের লক্ষ্য প্রথমে মেঘনা নদীর ওপর পুংলি সেতু দখল। এর ফলে জামালপুর ও ময়মনসিং ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানের ৯৩ ব্রিগেডের সেনা সদস্যদের ঢাকা যাওয়ার পথ আটকে দেওয়া। পুংলি থেকে ঢাকার দূরত্ব ১১৩ মাইল।
ঠিক দুপুর ২টা ২৩ মিনিটে দমদম ও কালাইকুন্ডা বিমান ক্ষেত্র থেকে দুটি সি-১১৯ পরিবহন বিমান ছত্রী সেনাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এছাড়াও ছিল এ এন-১২, সি-১১৯, ক্যারিবু ও ডাকোটা বিমান। বিমানে ওঠার আগে শেষবারের মত স্ত্রীকে ফোন করেছিলেন নির্ভয়, আশ্বাস দিয়েছিলেন এটা মোটেই বিপজ্জনক কোন অপারেশন নয়। আমাদের জন্য বন্ধুরা সেখানে অপেক্ষায় থাকবে, চিন্তা কর না। বললেন বটে, কিন্তু তিনি খুব ভাল করেই জানতেন এত বড় এয়ার ড্রপ ভারতীয় বাহিনী আগে কখনোই করেনি। হিসাবে সামান্য ভুল হলে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে।
৪:৩০ মিনিট, টাঙ্গাইল
ঘাটাইল ও কালিহাতীর ওপর দিয়ে পরপর দুটি ভারতীয় মিগ বিমান উড়ে যেতে দেখা গেল। এতে নূরুন নবী ও তার সহযোদ্ধারা নিশ্চিত হলেন ভারতীয় ছত্রী সেনা আসছে। মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে কয়েকদিন আগেই টাঙ্গাইল্ এসে পৌছেছিলেন ভারতীয় বাহিনীর বাঙালি ক্যাপ্টেন পিটার। তিনিই প্রথম আকাশে হাত তুলে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ওই যে, ওরা আসছে।
সাক্ষ্যভাষ্য: বিমানদুটি বেশ জায়গা নিয়ে চক্কর দিচ্ছিল। তাই আমরা বুঝতে পারছিলাম না যে আমাদের নির্দিষ্ট স্থানের কোথায় ওরা নামবে। একটু পরেই দেখতে পেলাম মিগ বিমানদুটির অনেক উপরে একঝাঁক বিমান আস্তে আস্তে চক্কর দিচ্ছে। মিগদুটি শাঁ করে অনেক উঁচুতে উঠে যাওয়ার পর উঁচুতে চক্কররত বিমানের ঝাঁকগুলো নিচে নেমে এল এবং খুব আস্তে আস্তে চক্কর দিতে লাগল। আমাদের কাছে মনে হচ্ছিল বিমানগুলো যেন দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই ছত্রীসেনা অবতরণ শুরু হল।
—আমার একাত্তর আমার যুদ্ধ, ড. নূরুন নবী, পৃ. ১৬৯
সাক্ষ্যভাষ্য: যেখানে আমাদের অবতরণের কথা, তার চারপাশে গ্রাম। শুরুতে গ্রামবাসী ভেবেছিল আমরা সম্ভবত পাকিস্তানি সেনা, অনেকে আকাশে আমাদের দেখামাত্র ভয়ে পালাতে শুরু করে। এইসময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আমাদের একজন প্যারাট্রুপার হঠাৎ চিৎকার উঠল, জয় বাংলা। আরো কয়েকজন ট্রুপার তার সঙ্গে যুক্ত হল। মুহুর্তে ভোজবাজীর মত পরিস্থিতি পাল্টে গেল। যেসব গ্রামবাসী ভীত হয়ে পালাচ্ছিল, এবার তারা সোৎসাহে ফিরে এল। সবাই আমাদের কাজে হাত লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ এগিয়ে দিল পানি, কেউবা আমাদের কাঁধের ব্যাগ তুলে নিল। আমাদের অপারেশন শুরু হবে, সবাইকে সরে যেতে বলা হল, কিন্তু অনেকেই সেকথায় কান না দিয়ে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল।
—লেফটেন্যান্ট জেনারেল নির্ভয় শর্মা, দি প্রিন্ট (ওয়েব পত্রিকা), ১১ ডিসেম্বর ২০১৯
ধবধবে সাদা হাসপাতাল শয্যায় শুয়ে অস্থির হয়ে এপাশ করছিলেন মেজর জেনারেল ইন্দের গিল। মিলিটারি অপারেশনের তিনি পরিচালক, টাঙ্গাইল ছত্রী অবতরণ অভিযানের প্রধান রূপকার। অথচ যুদ্ধের ময়দানের বদলে তিনি এখন হাসপাতালে শুয়ে। মাত্র দু’দিন আগে পাকিস্তানি সেনামুক্ত জামালপুরের দিকে তিনি জিপে করে যাচ্ছিলেন, সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার ক্লের। কামালপুর ও বক্সিগঞ্জের মাঝখানে পাকিস্তানিদের পুতে রাখা এন্টি-ট্যাঙ্ক মাইনের বিস্ফোরণে তার গাড়িটি উল্টে যায়। অজ্ঞান হয়ে পড়েন গিল। তাঁর অবর্তমানে অপারেশনের দায়িত্ব নিয়েছেন মেজর জেনারেল নাগরা।
জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর গিলের প্রথম প্রশ্ন ছিল, টাঙ্গাইলের কোন খবর আছে?
শনিবার বিকাল নাগাদ তাঁর অবস্থা বিপদমুক্ত হয়ে এলে টাঙ্গাইলে ক্যাপ্টেন পিটারের সঙ্গে ওয়ারলেসে যোগাযোগের নির্দেশ দিলেন তিনি। হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে প্রহরায় ছিলেন ক্যাপ্টেন সাহা। তরুণ অফিসার শশব্যস্ত হয়ে বললেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সবকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, এতক্ষণে এয়ার ড্রপ শুরু হয়ে গেছে।
কয়েকশ’ ছত্রী সেনা অবতরণের ফলে মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের মনোবল দারুন চাঙ্গা। মোট সাতশ’র মত ছত্রী সেনা অবতরণ করেছিল, কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ নানাভাবে প্রচার চালায় পাঁচ হাজারেরও বেশি ছত্রী সেনা টাঙ্গাইলে অবতরণের পরপরই অপারেশনে নেমে পড়েছে। বিষয়টি পাকিস্তানিদের মধ্যে রীতিমত আতঙ্কের সৃষ্টি করে। ভারতীয় বাহিনীর কাজের ভার অবশ্য অনেকটাই হালকা করে দিয়েছিল মুক্তি বাহিনী। আগের দিন প্রায় একটানা ১৬ ঘন্টা যুদ্ধ করেছে তারা, মধুপুর থেকে শোলাকুরা পর্যন্ত দীর্ঘ সড়ক পথ এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। সাঁড়াশি আক্রমণে দিশাহারা পাকিস্তানি বাহিনী পালাবার পথ খুঁজছে। তাদের পথ আটকে একদিকে ভারতীয় সেনা, অন্যদিকে মুক্তি বাহিনী। পুংলি সেতুর দখল নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে প্রায় ৩৭০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আহতের সংখ্যা শতাধিক। নিশ্চিত মৃত্যু এড়াতে পাক বাহিনীর সদস্যরা পোষাক বদলে দ্রুত ঢাকার পথে এগুতে চেষ্টা করে ব্যর্থ, মুক্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা।
আটককৃত পাকিস্তানি সেনাদের অন্যতম ছিলেন ব্রিগেডিয়ার কাদের খান। পোষাক বদলের কারণে কে সাধারণ সৈনিক, কে অফিসার তা বোঝার উপায় নেই। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব পেয়েছেন নূরুন নবী, এক ঝলক দেখেই টের পেলেন এদের মধ্যে কে কাদের খান। হাসি হাসি মুখ নিয়ে তার সামনে গিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সো ব্রিগেডিয়ার, হাউ আর ইউ?
চমকে তাকালেন ব্রিগেডিয়ার কাদের। তাঁর বুঝতে বাকি রইল না এই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার হাতে তিনি ধরা পড়ে গেছন।
সাক্ষ্যভাষ্য: ব্রিগেডিয়ার কাদের ধরা পড়ার ঘটনাটি এই রকম। ১১ ডিসেম্বর ঢাকার উত্তরে টাঙ্গাইলে ভারতীয় প্যারা ব্রিগেডের অবতরণ শুরু হয়। এই অবতরণ চলার সময় একই এলাকা দিয়ে ঢাকার পথে আসছিল এড হক ৯৩ ব্রিগেডের পাকিস্তানি সেনারা। ভারতীয়দের দেখামাত্রই তাদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদির ভাবলেন এরা হয়ত সেই প্রতিশ্রুত বিদেশী বন্ধুরা, যারা পাক সেনাদের সাহায্যে এসেছে। কাদির খান এইসব ‘বন্ধুদের’ স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসতেই তাকে বন্দী করা হয়। তিনিই প্রথম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার যিনি এই যুদ্ধে আটক হন। পুংলির এই সম্মুখ সমর শেষে দুই ব্যাটালিয়ন বাহিনীর ৯০০ সৈনিক ও অফিসার ঢাকা এসে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
—পাকিস্তান’স ক্রাইসিন ইন লিডারশিপ, মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খান, ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশন, ১৯৭৩, পৃ. ১৮৫-১৮৬
টাঙ্গাইলে ছত্রী অবতরণের বিষয়টি ঘনিষ্ঠ ভাবে নজরে রাখছিলেন ভারতীয় সেনা বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ড। এই অপারেশনের সাফল্য সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, পাকিস্তানি প্রতিরক্ষ্যব্যুহ অতিক্রম করে অনায়াসে হাজার হাজার ভারতীয় ছত্রী সেনা অবতরণে সক্ষম হয়েছে একথা যদি প্রচার পায় তাহলে পূর্ব রণাঙ্গনে সকল পাকিস্তানি সৈনিক ও তাদের কমান্ডারদের মনোবল ভেঙ্গে পড়বে। সেনা প্রধান জেনেরাল স্যাম ম্যানেকশ নির্দেশ দিয়েছিলেন এই মনস্তাত্বিক অপারেশন যেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। এই কাজের ভার দেওয়া হয় পূর্ব কম্যান্ডের প্রধান তথ্য অফিসার কর্নেল বি পি রিখিকে।
অপারেশন সফল, কিন্তু সেকথা প্রমাণের জন্য ছবি চাই। বিপদে পড়লেন রিখি, টাঙ্গাইল থেকে কোন ছবি এসে পৌঁছায়নি। তার সাহায্যে এগিয়ে আসলেন ভারতীয় গোয়েন্দা দপ্তর র’র প্রধান আর এন কাও। তার নির্দেশে পুরানো রেকর্ড খুঁজে প্যারা ড্রপের ছবি বার করা হল। সপ্তাহ দুয়েক আগে আগ্রায় প্যারাট্রুপ অবতরণের মহড়া হয়েছিল, ষে মহড়ার একটি ছবি বেছে নিলেন তিনি। দেশী–বিদেশী সংবাদপত্র ও এজেন্সির মাধ্যমে সেই ছবিই পরদিন ছাপা হল পৃথিবীর সর্বত্র।
সাক্ষ্যভাষ্য: আমার বাছাই সেই ছবির সঙ্গে ক্যাপশনে ছিল, টাঙ্গাইলে এক ব্রিগেড ভারতীয় ছত্রী সেনা অবতরণ করেছে। এক ব্রিগেড মান পাঁচ হাজার, অথচ সেদিন অবতরণ করে হাজার খানেক ছত্রী সেনা। আমি বলিনি এটা ছিল ফাইল ফটো। সেটা ইচ্ছাকৃত। কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার নয়, কিন্তু একদম সত্যও নয়।
—আর এন কাও, স্বরাজ্য ম্যাগাজিন, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০
যেসব বিদেশী পত্র-পত্রিকায় এয়ারড্রপের ছবিটি ছাপা হয় তার একটি ছিল লন্ডন টাইমস। কাও স্মরণ করেছেন, জেনারেল নিয়াজীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তার নিয়ন্ত্রণে প্রায় এক লাখ সৈন্য মওজুদ থাকা সত্বেও তিনি এত চট করে আত্মুসমর্পনে সম্মত হলেন কেন। পাকিস্তানি জেনারেল টাইমসের ছবিটির দিকে আঙ্গুল তুলে বলেছিলেন, এই ছবিটির জন্য।
সাক্ষ্যভাষ্য: ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে সফল ছত্রী অবতরণের খবর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনা দপ্তরে এসে পৌঁছাতে বিলম্ব হল না। দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন নিয়াজী। সেদিন সকালেই তিনি ইসলামাবাদে সেনা প্রধানের উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠিয়েছেন, দ্রুত বিদেশী সাহায্য এসে না পৌঁছালে বিপর্যয় ঠেকানো অসম্ভব হবে। নরসিংদী ও টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রী সেনা অবতরণ করেছে, পাক বাহিনী তাদের গায়ে আচড়টুকুও লাগাতে পারেনি। উদভ্রান্ত হয়ে সে রাতে নিয়াজী ইসলামাবাদে জরুরী তারবার্তা পাঠালেন, ‘শত্রুপক্ষ নরসংদীতে হেলিকপ্টারে এক ব্রিগেড ও টাঙ্গাইলে এক ব্রিগেডে ছত্রী সেনা নামিয়েছে। অনুরোধ করছি যেন ১২ ডিসেম্বর সকালেই আমাদের বন্ধুরা ঢাকা এসে পৌঁছান।’
—দ্য সেপারেশন অফ ইস্ট পাকিস্তান, হাসান জহির, অক্সফোর্ড প্রেস, ১৯৯৪, পৃঃ ৩৯৪
ভারতীয় ছত্রী সেনা ও মুক্তি বাহিনীর যৌথ অভিযানে পুংলি সেতু এখন তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। দিনের বেলা টাঙ্গাইল ও তার আশেপাশে আটকে পড়া পাকিস্তানি সৈন্যরা চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়েছিল। জেলা সদরেও তৎপর পাকিস্তানিরা। চুড়ান্ত পাল্টা আঘাতের জন্য আয়োজন শুরু হয়। ভারতীয় বাহিনী আগ্রহ প্রকাশ করল এই অপারেশনে তারা যুক্ত হবে। কাদের সিদ্দিকী ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, না, এটা আমাদের যুদ্ধ, আমাদের লড়তে দিন।
সেদিনই শত্রু মুক্ত হল টাঙ্গাইল।
নয় মাস কেটে গেছে, নূরুন নবী এই পুরো সময় যুদ্ধের ময়দানে কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে। মাঝে একবার লুকিয়ে খামারপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে বাবার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। স্বর্গত মায়ের কথা মনে পড়ে। দেশ স্বাধীন হতে চলেছে, একথা জানলে সবচেয়ে খুশি হতেন তিনি। তাঁর দুই চোখ জ্বালা করে ওঠে। দূরে কোথাও কে যেন গুলি ছুড়ছে, হয়ত বিজয় আনন্দে। নাড়ার আগুনে কারা যেন আলূ পোড়াচ্ছে, মিষ্টি একটা গন্ধ এসে নাকে। নূরুন নবী আকাশের দিকে তাকান, চোখে পড়ে সপ্তর্ষি মন্ডল। সেদিকে চোখ রেখে ফিস ফিস করে বলেন, তোমার টাঙ্গাইল এখন স্বাধীন। ক’দিন বাদেই স্বাধীন হবে পুরো বাংলাদেশ।