কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সুরিকরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ হাসান। তিনি একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি। দেশে করোনা মহামারির শুরুর সময়ে সরকারের ই-লার্নিং পোর্টাল ‘মুক্তপাঠ’-এ গণিত অলিম্পিয়াডের ওপর একটি কোর্স করার চেষ্টা করেন হাসান। কিন্তু পোর্টালটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীবান্ধব না হওয়ায় তখন কোর্সটি করতে পারেননি তিনি।
পরে মোহাম্মদ হাসান বিষয়টি জানান অ্যাসপায়ার টু ইনোভেটের (এটুআই) কর্মকর্তাদের। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও আইসিটি বিভাগের বাস্তবায়নাধীন এটুআই প্রকল্প থেকে ‘মুক্তপাঠ’কে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিহ্নিত সমস্যাগুলো তাঁদের পরামর্শের ভিত্তিতেই সমাধান করা হয়। বর্তমানে ‘মুক্তপাঠ’-এর অধিকাংশ কোর্স দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী।
‘মুক্তপাঠ’ বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মটির স্লোগান ‘শিখুন, যখন যেখানে ইচ্ছে’। যে কেউ এখানে বিনা মূল্যে বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স করতে পারেন। মুক্তপাঠে কোর্স করতে হলে প্রথমে ব্যক্তির নাম, মুঠোফোন নম্বর বা ই–মেইল অ্যাড্রেস ও পাসওয়ার্ড দিয়ে নিজস্ব আইডি খুলতে হয়।
মুক্তপাঠকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহার উপযোগী করতে সব পক্ষের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছেন এটুআইয়ের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট (অ্যাকসেসিবিলিটি) ভাস্কর ভট্টাচার্য। তিনি নিজেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি।
ভাস্কর ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘ই-লার্নিংকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে চাচ্ছে সরকার। মুক্তপাঠ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী হয়েছে। কিন্তু সেটি নিয়ে প্রচার কম। তাই অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি এখনো এটি ব্যবহার করছেন না।’
মুক্তপাঠে কোর্স করার জন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রয়োজন হয় ‘নন-ভিজ্যুয়াল ডেস্কটপ অ্যাকসেস’ (এনভিডিএ) নামের স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যারের। এটি একটি উন্মুক্ত সফটওয়্যার। ডাউনলোড করে ইনস্টল করে নিলেই হয়। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই এটি ব্যবহার করা যায়। সফটওয়্যারটির মাধ্যমে স্ক্রিনে আসা কোর্সের প্রতিটি লেখা পড়ে শোনানো হয়।
বর্তমানে মুক্তপাঠ পোর্টালে প্রবেশ করলে স্ক্রিনের ডান পাশে ‘অ্যাকসেসিবিলিটি মেনু’ নামে একটি বোতাম পাওয়া যায়। সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়তার বিষয় রয়েছে।
‘অ্যাকসেসিবিলিটি মেনু’-তে রয়েছে ‘মনোক্রম’ (রঙিনের বদলে সাদাকালো লেখা), ‘ইনভার্ট কালারস’ (স্ক্রিন ছবির নেগেটিভের মতো হয়ে যায়), ‘বিগ কার্সর’ (কম্পিউটারের মাউসের নির্দেশক চিহ্নের বড় আকৃতি), ‘হাইলাইট লিংকস’ (প্রধান শিরোনামগুলো সবুজ রং দিয়ে চিহ্নিত করা), ‘শো হেডিংস’ (শুধু শিরোনামগুলো দেখানো), ‘রিডিং গাইড’ (সবুজ রঙের রেখা দিয়ে প্রতিটি লাইন পড়ার ব্যবস্থা) ও ‘কি-বোর্ড শর্টকাট’। আর সবশেষে রয়েছে স্ক্রিন রিডার ডাউনলোডের ব্যবস্থা।
মুক্তপাঠে মোট কোর্স আছে ২১৯টি। এসব কোর্স তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, ফ্রিল্যান্সিং, আত্মকর্মসংস্থান, ব্যক্তিগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, সাংবাদিকতা ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান–বিষয়ক। কোর্সগুলোর সঙ্গে মোট ১২ লাখ ৩২ হাজার ৩৫৪ শিক্ষার্থী যুক্ত আছেন।
মুক্তপাঠকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহারের উপযোগী করতে ‘অ্যাকসেসিবিলিটি অডিটরস প্যানেল’-এর সহায়তা নেওয়া হয়ে থাকে। সরকারের বিভিন্ন ওয়েবসাইট, অনলাইন সেবা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য কতটা উপযোগী, তা যাচাই করতে এ প্যানেল গঠন করা হয়েছে।
বর্তমানে ২৫ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এ প্যানেলে আছেন। তাঁরা সরকারি ওয়েবসাইট–সংক্রান্ত সেবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কী কী সমস্যা হয়, সেগুলো চিহ্নিত করেন। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে সমস্যাগুলো সমাধান করা হয়।
অ্যাকসেসিবিলিটি অডিটরস প্যানেলের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন আমজাদ হোসাইন। তিনি বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান শাখায় কর্মরত। আমজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তপাঠ শুরুর সময় খুব আশাবাদী ছিলাম। পরে দেখা গেল, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা মুক্তপাঠ ব্যবহার করতে পারছেন না। তখন কয়েক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি মিলে কী কী সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধানে করণীয় কী, তা প্রস্তাব আকারে তুলে ধরেন।’
এটুআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সরকারের তিন ধরনের প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে মুক্তপাঠের মতো ই-লার্নিংকে সামনে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি ছিল সব ই-সেবা হবে প্রতিবন্ধীবান্ধব। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে বলা আছে, তথ্যপ্রযুক্তিকে অভিগম্য করতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের তফসিলে ‘তথ্য বিনিময় এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি’ নামে একটি আলাদা অংশ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ইন্টারনেটে যে তথ্য ও সেবা প্রচার করবে, সেগুলো বিভিন্ন প্রযুক্তি ও পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। সরকারি সংস্থাগুলোর যেসব ই-সেবা রয়েছে, সেগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহজ প্রবেশ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের ওয়েবসাইটসহ বিভিন্ন অনলাইন সেবা পেতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কী কী সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়তা নিয়েই সেগুলো সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।