ঝিনাইদহ জেলা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের দ্যুতিতে বর্ণময় এ জেলা। ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অফুরান সম্পদে সমৃদ্ধ এই জনপদ ঝিনাইদহ।
খেজুরের গুড়, কলা-পানের প্রাচুর্যমণ্ডিত ঝিনাইদহের রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। প্রকৃতির সজীবতা এবং প্রাণজুড়ানো আবহাওয়া ছাড়াও এই জেলায় রয়েছে চমৎকার প্রাচীন মসজিদ, মন্দির এবং প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর বিভিন্ন ভবন। প্রাচীনকালে নির্মিত এসব স্থাপনায় রয়েছে চমৎকার শৈল্পিক কারুকাজ।
মনের অবসাদ দূর করতে ভ্রমণ বা বিনোদনের কোনো বিকল্প নেই। আর তা যদি হয় প্রাচীন পুরাকীর্তি বা জমিদারবাড়ি, তবে তো কথা–ই নেই। যান্ত্রিক জীবনে শতব্যস্ততার বাইরে ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য আদর্শ ভ্রমণ স্থান হতে পারে ঝিনাইদহের মিয়ার দালান। যার দেয়ালের পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া। শানশওকত আর চাকচিক্যের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে দেশের বেশির ভাগ জমিদারবাড়িই এখন পরিত্যক্ত। মিয়ার দালান ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত একটি পুরোনো জমিদারবাড়ি। এটি নবগঙ্গা নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত। ঝিনাইদহ শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।
গত সোমবার (১৩ জুলাই) বেলা চারটায় শুরু হলো আমাদের মিয়ার দালান যাত্রা। মহামারি কোভিড-১৯–এর প্রাদুর্ভাবের কারণে যাত্রা শুরুর আগে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালো করে সবাই হাত ধুয়ে নিলাম এবং মুখে মাস্ক পরে বের হলাম। আমরা আট বন্ধু, চারটি মোটরসাইকেল নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলার মহিলা কলেজ গেট থেকে নলডাঙ্গা গ্রামের সড়ক ধরে চলে গেলাম মিয়ার দালান। যতই গ্রামের পথ চলছি, ততই প্রকৃতিপ্রেমে পড়ে যাচ্ছি। জীবনের পুরো সময় এই প্রকৃতির মধ্যে কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা করছে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।
বলে রাখা ভালো, কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে ঝিনাইদহের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। কিন্তু আমরা মহাসড়ক ধরে না যাওয়াই ৩০ মিনিট সময় বেশি লাগল। বিকেল থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমরা ওখানেই ছিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখলাম দালানের চারপাশ। বন্ধুরা স্মৃতি ধরে রাখতে নিজেদের মতো করে সামাজিক দূরত্ব বজিয়ে রেখে সেলফি, গ্রুপ ছবি তুলে নিল। তারপর ওখান থেকে ঝিনাইদহ শহরে কিছুক্ষণ ঘুরে চলে এলাম কালীগঞ্জে।
সময় চলে যায়, তবে স্মৃতিগুলো থেকে যায় আজীবন। তেমনি মিয়ার দালান ভ্রমণের স্মৃতিগুলো মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে আজীবন। হয়তো আবার দেশ সুস্থ হলে স্মৃতিচারণা করে ঘুরে বেড়াব এই শহরের পথেঘাটে।
যত দূর জানা যায়, ১২২৯ বঙ্গাব্দে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু করেন তত্কালীন জমিদার সলিমুল্লাহ চৌধুরী। ৭৫ হাজার টাকা ব্যয়ে বাড়িটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১২৩৬ বঙ্গাব্দে। সলিমুল্লাহ চৌধুরী স্থানীয় লোকজনের কাছে মিয়া সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। সে জন্য বাড়িটি মিয়ার দালান বলে পরিচিতি পায়। তবে যে জমিদার এই দালানটি নির্মাণ করেন তিনি ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় ভবনটি কিনে নেন সেলিম চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি। তাই ভবনটিকে স্থানীয়ভাবে কেউ কেউ সেলিম চৌধুরীর বাড়িও বলে থাকে।
কথিত আছে, সলিমুল্লাহ চৌধুরীর পিতা বধুই বিশ্বাস ছিলেন নলডাঙ্গা রাজবংশের দেওয়ান। বধুই বিশ্বাসের মৃত্যুর পর সলিমুল্লাহ নলডাঙ্গা রাজবংশের কর্মচারী হিসেবে যথেষ্ট উন্নতি করেন এবং তাঁকে চৌধুরী উপাধি দেওয়া হয়। তিনি মুরারী নামে এক হিন্দু রমণীর প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন। পরবর্তী সময়ে ওই নারীর নাম পরিবর্তন করে বিবি আশরাফুন্নেসা রাখা হয়। মিয়ার দালানের প্রধান ফটকে খোদাই করা লেখায় তাঁর কথাসহ নির্মাণের বিষয় উল্লেখ রয়েছে।
তাতে লেখা আছে, ‘শ্রীশ্রী রাম, মুরারীদহ গ্রাম ধাম, বিবি আশরাফুন্নেসা নাম, কী কহিবা হুরির বাথান। ইন্দ্রের অমরাপুর নবগঙ্গার উত্তর ধার, ৭৫,০০০ টাকায় করিলাম নির্মাণ। এ দেশে কাহার সাধ্য বাধিয়া জল মাঝে কমল সমান। কলিকাতার রাজ চন্দ্র রাজ, ১২২৯ সালে শুরু করি কাজ, ১২৩৬ সালে সমাপ্ত দালান।’
বলা হয়ে থাকে, বাড়িটি থেকে নবগঙ্গা নদীর নিচ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ ছিল। সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ এখনো চিহ্নিত করা যায়। নদীতে যেভাবে বাধ দিয়ে ইমারতটি নির্মাণ করা হয়েছিল, সেভাবে তৈরি আর কোনো পুরোনো ইমারত ঝিনাইদহ শহরে দেখা যায় না। বাড়িটির ব্যাপক পরিচিতির একটি বড় কারণ একটি বিশেষ খেজুরগাছ। যে গাছটিতে একাধিক মাথা ছিল এবং প্রতিটি মাথা থেকেই রস আহরণ করা যেত। তবে এখন আর খেজুরগাছটি নেই।
বাড়িটি দেখলে মনে হয় নদীগর্ভে দাঁড়িয়ে আছে। চুন-সুরকির সঙ্গে ইটের গাঁথুনির এ বাড়িটির দেয়াল ২৫ ইঞ্চি পুরু। উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্য প্রায় ৮২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৬৬ ফুট। এ ভবনে ছোট-বড় ১৬টি কক্ষ রয়েছে। দ্বিতীয় তলার ছাদের ওপর রয়েছে একটি চিলেকোঠা। শ্বেতপাথর দিয়ে আচ্ছাদিত এই চিলেকোঠা নামাজঘর হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল।
তবে সংরক্ষণ আর তদারকির অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ২০০ বছর আগে নির্মিত এই মিয়ার দালান। কয়েক বছর আগেও এ স্থাপত্য দেখতে দর্শনার্থীরা ভিড় করলেও এখন কেউ সেদিকে পা বাড়ান না। যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে এ স্থাপনা হয়ে উঠতে পারে অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।
দেশের যেকোনো স্থান থেকে ঝিনাইদহ শহরে পৌঁছে ইজিবাইক, ভ্যান, রিকশায় মিয়ার দালান জমিদারবাড়ি যাওয়া যায়।