প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের চুক্তি অবিলম্বে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে, তাই তার সমাধানও হতে হবে মিয়ানমারে। কিন্তু মিয়ানমার মৌখিকভাবে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় সময় ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩ তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি হয়েছে, আমরা তারও আশু বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা দেখতে চাই। আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় প্রদান করেছে, যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশ সাধ্যমতো তাদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও শিশুদের যত্নের ব্যবস্থা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় প্রথম থেকেই আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে মিয়ানমার মৌখিকভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যে বিবরণ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তাতে আমরা হতভম্ব। একজন মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশাকে আমরা যেমন অগ্রাহ্য করতে পারি না, তেমনি পারি না নিশ্চুপ থাকতে। আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও অবিচারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা যত দিন তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে না পারবে, তত দিন সাময়িকভাবে তারা যাতে মানসম্মত ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে বসবাস করতে পারে, সে জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রেখে আমরা নতুন আবাসন নির্মাণের কাজ শুরু করেছি। রোহিঙ্গাদের মানসম্মত পরিবেশে বসবাস নিশ্চিত করতে তাঁর সরকারের রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের উদ্যোগে সহযোগিতার জন্যও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে তিনটি মৌলিক উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তা হলো—শান্তি, মানবতা ও উন্নয়ন। তাই মানব সমাজের কল্যাণে আমাদের মানবতার পক্ষে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। জনগণকে সেবা প্রদান ও তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। মানবতা ও সৌহার্দ্য আমাদের টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সমস্যা-সংকুল এই পৃথিবীতে আমাদের সম্মিলিত স্বার্থ, সমন্বিত দায়িত্ব ও অংশীদারত্বই মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অধীনে ৫৪টি মিশনে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১০ জন শান্তিরক্ষী প্রেরণের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি রক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১৪৫ জন শান্তিরক্ষী জীবনদান করেছেন। বর্তমানে ১০টি মিশনে ১৪৪ জন নারীসহ বাংলাদেশের মোট ৭ হাজারেরও বেশি শান্তিরক্ষী নিযুক্ত রয়েছেন। আমাদের শান্তিরক্ষীগণ তাঁদের পেশাদারি, সাহস ও সাফল্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।
বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদসহ সব সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রম বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে দেওয়া হবে না। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আমাদের ‘জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সংসদই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র সংসদ যেখানে সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, স্পিকার ও বিরোধী দলীয় নেতা নারী। বর্তমান সংসদে ৭২ জন নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বাধিক ঝুঁকির সম্মুখীন পৃথিবীর প্রথম দশটি দেশের একটি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে আমরা আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের এক শতাংশ ব্যয় করছি। জলবায়ু সহায়ক কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ও ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন সংরক্ষণে ৫ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।