‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’। মাতৃভাষার জন্য বাঙালির রক্তদানের স্মৃতি জড়ানো একুশের গানের রচয়িতা, প্রবীণ সাংবাদিক, কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় সকাল ৬টা ৪৯ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র জানিয়েছে, গাফ্ফার চৌধুরী ডায়াবেটিস, কিডনি রোগসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। এক বছর ধরে প্রায়ই তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হতো। তবে গত প্রায় তিন মাস তিনি বার্নেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
গাফ্ফার চৌধুরী লন্ডন থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে দীর্ঘ বছর নিয়মিত কলাম লিখে গেছেন। দেশের চলমান পরিস্থিতি ও ঘটনার ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ বজায় রাখতেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে তাঁর কলম ছিল সোচ্চার। রাজনৈতিক ধারাভাষ্য আর সমকালীন বিষয়ের পাশাপাশি তিনি লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, স্মৃতিকথা ও প্রবন্ধ।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মিনিস্টার (প্রেস) আশিকুন্নবী চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় প্রথম আলোকে জানান, গাফ্ফার চৌধুরীর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকার মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্ত্রীর পাশেই শেষ শয্যা নেবেন তিনি।
রাতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গাফ্ফার চৌধুরীর জানাজা আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে। সংশ্লিষ্ট সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাঁর মরদেহ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় পাঠানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন চার মেয়ে ও এক ছেলের জনক। তাঁর মেয়ে বিনীতা চৌধুরী ৫০ বছর বয়সে গত ১৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। হাসপাতালে থেকেই মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছিলেন তিনি। বিনীতা চৌধুরী বাবার সঙ্গে লন্ডনের এজওয়ারের বাসায় থাকতেন ও তাঁকে দেখাশোনা করতেন।
গবেষক ফারুক আহমদের বিলেতে বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা বইয়ে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর স্ত্রী সেলিনা আফরোজের চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আসেন। এরপর এখানেই থেকে যান তিনি।
গাফ্ফার চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়া গ্রামে। ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
স্কুলে পড়ার সময় কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত কংগ্রেস হিতৈষী পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয় সওগাত পত্রিকায়। পরে দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক সংবাদ, মাসিক সওগাত, মাসিক নকীব পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাক–এ। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জয় বাংলা, যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেন।
গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৭৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলার ডাক, ১৯৮৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক নতুন দিন, ১৯৯০ সালের ১৪ মার্চ সাপ্তাহিক নতুন দেশ এবং ১৯৯২ সালের ১০ জানুয়ারি সাপ্তাহিক পূর্বদেশ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তাঁর হাতে পাক্ষিক জাগরণ পত্রিকাটি সাপ্তাহিক জাগরণ–এ উন্নীত হয়ে বিলেতে একটি প্রথম শ্রেণির বাংলা সংবাদপত্রে পরিণত হয়।
সাপ্তাহিক জনমত–এর সাবেক সম্পাদক নবাব উদ্দিন প্রথম আলোকে জানান, বিলেতে শুরুর দিকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লন্ডনের কমিউনিটি স্কুলগুলোতে শিক্ষকতা করেছেন। অনুবাদকের কাজ করেছেন। তিনি বিলেতে আগমনের পর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছিলেন সাপ্তাহিক জনমত–এর নিয়মিত কলাম লেখক।
গাফ্ফার চৌধুরীর প্রথম উপন্যাসের নাম চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান। নাম না জানা ভোর, নীল যমুনা, শেষ রজনীর চাঁদ, সম্রাটের ছবি, সুন্দর হে সুন্দর, বাংলাদেশ কথা কয় তাঁর লেখা বইগুলোর অন্যতম। তাঁর লেখা নাটকের মধ্যে রয়েছে পলাশী থেকে বাংলাদেশ, একজন তাহমিনা ও রক্তাক্ত আগস্ট।
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেসকো পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মানিক মিয়া পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন গাফ্ফার চৌধুরী। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে।
সাপ্তাহিক নতুন দিন–এর সম্পাদক মুহিব চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে জানতে গাফ্ফার চৌধুরীর লেখার বিকল্প ছিল না। দেখেছি বাংলাদেশ থেকে কোনো রাজনীতিবিদ এলেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। গাফ্ফার চৌধুরীও তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে উৎসাহী ছিলেন। এটা ছিল তাঁর বড় গুণ।’
বাসস জানায়, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাংলাদেশ প্রগতিশীল, সৃজনশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন অগ্রপথিককে হারাল।রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘তাঁর মৃত্যু দেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। মরহুম আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর কালজয়ী গান ও লেখনীর মাধ্যমে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবেন।’ তিনি গাফ্ফার চৌধুরীর রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে আমার বহু স্মৃতি জড়িত। অনেক পরামর্শ পেয়েছি। একজন বিজ্ঞ ও পুরোধা ব্যক্তিত্বকে হারালাম, যিনি তাঁর লেখা ও গবেষণায় আমাদের বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।’