পবিত্র হজ পালনের জন্য মক্কায় সমবেত সারা বিশ্বের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান গতকাল শুক্রবার মসজিদুল হারামে (কাবা শরিফ) জুমার নামাজ আদায় করেছেন। পবিত্র হজের আগে এটি শেষ জুমা। বিশাল জামাতে নানা দেশের, নানা বর্ণের, নানা গোত্রের মানুষ দাঁড়িয়েছেন এক কাতারে।
জুমার নামাজ আদায় করার পর হজযাত্রীরা পবিত্র হজের অংশ হিসেবে মিনায় পৌঁছেছেন। ভিড় এড়ানোর জন্য মোয়াল্লেম গাড়িতে করে আমাদের মিনায় নিয়ে এসেছেন। অন্য সময় গাড়িতে মিনায় পৌঁছাতে ২০ মিনিট লাগে। রাস্তায় তীব্র যানজটের কারণে গতকাল লাগল দুই ঘণ্টারও বেশি। মিনামুখী পুরো রাস্তায় হজযাত্রীদের স্রোত। বাসে, গাড়িতে, হেঁটে মিনায় যাচ্ছেন তাঁরা। সেলাইবিহীন দুই টুকরা সাদা কাপড় পরে হজের নিয়তে তাঁদের মুখে ছিল তালবিয়া ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা’। যানজটে আটকে পড়া কেউ কেউ দোয়ার বই পড়ছিলেন। আর যাঁরা অপেক্ষা করতে চাননি, তাঁরা হেঁটেই রওনা হন। কাঁধে ছোট ঝোলা। অনেক বৃদ্ধকে হুইলচেয়ারে যেতে দেখা গেল। মিনার প্রবেশপথ দিয়ে হজের অনুমতিপত্র ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
পবিত্র মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দূরের মিনা এখন যেন তাঁবুর শহর। যেদিকে চোখ যায়, তাঁবু আর তাঁবু। তাঁবুতে প্রত্যেকের জন্য আলাদা ফোম, বালিশ, কম্বল বরাদ্দ। ফোমের নিচে বালু। মিনায় অবস্থান করা হজের অংশ। হজযাত্রীরা নিজ নিজ তাঁবুতে নামাজ আদায়সহ অন্যান্য ইবাদত করছেন।
মিনায় রাতযাপন জীবনের এক পরম পাওয়া। আজ ৮ জিলহজ হজযাত্রীরা মিনায় অবস্থান করবেন। ৯ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে আরাফাতের ময়দানে যাবেন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করবেন। এরপর প্রায় আট কিলোমিটার দূরে মুজদালিফায় গিয়ে রাতযাপন ও পাথর সংগ্রহ করবেন। ১০ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে মুজদালিফা থেকে মিনায় ফিরবেন।
হাজিরা মিনায় বড় শয়তানকে পাথর মারবেন, কোরবানি দেবেন, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেঁটে মক্কায় গিয়ে কাবা শরিফ তাওয়াফ করবেন। তাওয়াফ, সাঈ শেষে আবার মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ অবস্থান করবেন। সেখানে প্রতিদিন তিনটি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবেন তাঁরা। প্রত্যেক শয়তানকে সাতটি করে পাথর মারতে হয়। মসজিদে খায়েফের দিক থেকে মক্কার দিকে আসার সময় প্রথমে জামারায় সগির বা ছোট শয়তান, তারপর জামারায় ওস্তা বা মেজো শয়তান, এরপর জামারায় আকাবা বা বড় শয়তান। তিন শয়তানকে তাকবিরসহ পাথর নিক্ষেপ করা হজের অপরিহার্য অংশ। শয়তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই পাথর নিক্ষেপ করা হয়।
মিনায় মোট সাতটি জোন রয়েছে। ২, ৫, ৬ নম্বর জোনে বাংলাদেশিদের তাঁবু। আমাদের তাঁবু ২ নম্বর জোনে, তাঁবু নম্বর ১৬ বাই ৫৬ (অর্থাৎ ৫৬ নম্বর রাস্তার ১৬ নম্বর তাঁবু)।
হাজিরা যাতে নির্বিঘ্নে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতে পারেন, সে জন্য ওই জায়গা সম্প্রসারণ করা হয়। সৌদি গ্রাম ও পৌরবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হাবিব জয়নাল আবেদিন বলেন, জামারায় প্রতি তলার দৈর্ঘ্য ৯৫০ মিটার আর প্রস্থ ৮০ মিটার। প্রতি ঘণ্টায় তিন লাখ হাজি পাথর নিক্ষেপ করতে পারবেন।
এবার হাজিদের পাথর মারার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মোয়াল্লেম নম্বর অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পাথর মারতে হবে।
মিনার তাঁবুগুলোতে আগুন ধরার ঝুঁকি নেই। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত তাঁবু। তাঁবুগুলো দেখতে একই রকম হওয়ায় অনেক হাজির পক্ষে পথঘাট ঠিক রেখে নিজের তাঁবুতে যাতায়াত করা কঠিন হয়। এর জন্য এখানে আছে স্কাউট, হজগাইড। বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের পক্ষ থেকেও হজযাত্রীদের সহায়ক মিনার তাঁবু নম্বরসংবলিত মানচিত্র বিতরণ করা হচ্ছে।
মিনায় ১৬/৫৬ নম্বর তাঁবু, অর্থাৎ বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের সামনে অনেক হজযাত্রী ভিড় জমান। তাঁবু দেখতে একই রকম হওয়ায় হজযাত্রীরা কিছুক্ষণের জন্য নিজের তাঁবু হারিয়ে ফেলেন। তাঁদের নিজ নিজ তাঁবুতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
হজযাত্রীরা মিনার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখছেন। ১০ জিলহজের পর জামারায় খুব ভিড় থাকে। তখন ভালো করে দেখা যায় না। মিনার কাছেই সৌদি বাদশাহর বাড়ি, রাজকীয় অতিথি ভবন। হজযাত্রীরা মোয়াচ্ছাসা (হজের সার্বিক বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ) কার্যালয়, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখছেন।
ঢাকার ফ্রি স্কুল স্ট্রিট থেকে খালাকে নিয়ে হজ করতে এসেছেন আতাউর রহমান ও ফরিদা জামান। দুজন বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখছেন। মিনার একমাত্র মসজিদ মসজিদে খায়েফের সামনে গিয়ে তাঁদের বেশ ভালো লাগল। কারণ, সেখানে বাংলায় লেখা মসজিদে খায়েফ। আরও কয়েকটি ভাষায়ও মসজিদের নাম লেখা আছে। মসজিদে খায়েফ ঘুরে দেখছিলেন মো. নাজমুল হুদাও।
কেউ কেউ গত বছর মিনার দুর্ঘটনাস্থল ২০৪ নম্বর রাস্তাও দেখার জন্য আসেন। গতবার হজ করেছেন এমন কয়েকজন ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। হজের আরও তথ্য জানতে পারবেন www.hajj.gov.bd এই ঠিকানায়।