জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল

মিথ্যা সাক্ষ্যে ভাতা স্থগিত ১০০ বীর মুক্তিযোদ্ধার

আর্থিক সুবিধা পেয়ে কিংবা দ্বন্দ্বের কারণে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগ। দুই মাস থেকে এক বছরের জন্য পর্যন্ত সম্মানী ভাতা স্থগিত।

প্রায় ১০০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা স্থগিত করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্নজনের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে অথবা দ্বন্দ্বের কারণে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সম্মানী ভাতা স্থগিত থাকছে তাঁদের।

ইতিমধ্যে এই আদেশ কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয় বলছে, কারও মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে যদি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানি হয় বা ক্ষতি হয়, তবে মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হতে পারে। এমনকি হতে পারে ফৌজদারি মামলাও। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ছয় মাস আগে থেকে এমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুব কষ্ট হয় বলতে যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এমন মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন। নিজেদের ঝগড়া-বিবাদের কারণে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্য দিচ্ছেন। আবার যিনি মুক্তিযোদ্ধা নন, তাঁকে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা। এসবের জন্য দূরদূরান্ত থেকে তাঁরা মন্ত্রণালয়ে আসছেন। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানি হচ্ছে। অন্যদিকে বাড়ছে অমুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা।’

মন্ত্রী বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই এ ধরনের অপরাধ চলছে। সতর্ক করেও কাজ হয়নি। তাই এবার আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি সনদ বাতিল।’

সূত্র জানিয়েছে, সম্মানী ভাতা স্থগিত হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। তবে ভাতা স্থগিত হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে বলেছেন, তাঁরা এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।

কয়েকটি ঘটনা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুরের মৃত আরব আলীর পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগে ভাতা বন্ধ করা হয়েছে গোপালগঞ্জের আ. রহমান শরীফ ও মাদারীপুরের ফজলুল হক নামের দুই বীর মুক্তিযোদ্ধার। ৪ জানুয়ারি তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আরব আলীর বড় ছেলে বাবার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আদালতে রিট করেন। রিটের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এ বিষয়ে যাচাই–বাছাইয়ের জন্য পুরো বিষয়টি তদন্ত করে।

তদন্তের সময় সহযোদ্ধা হিসেবে সাক্ষ্য দেন গোপালগঞ্জের আ. রহমান শরীফ ও মাদারীপুরের ফজলুল হক। তদন্তে আরব আলীর বিষয়ে দুজনই মিথ্যা সাক্ষ্য দেন বলে প্রমাণিত হয়। এর ফলে তাঁদের সম্মানী ভাতা বাতিল করা হয়।

মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানি হচ্ছে। অন্যদিকে বাড়ছে অমুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা।
আ ক ম মোজাম্মেল হক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

জানতে চাইলে আ. রহমান শরীফ বলেন, ‘মাদারীপুরের ফজলুল হক ও আমার বক্তব্য না মেলায় আমাদের ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। আসলে আরব আলী হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। তিনি (ফজলুল হক) বলেছেন, আরব আলী যুদ্ধ করেছেন খলিল বাহিনীর সঙ্গে।’

আপনি কেন গেছেন সাক্ষ্য দিতে, জানতে চাইলে রহমান শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরব আলীর ছেলে–বউ কান্নাকাটি করে আমাকে নিয়ে গেছে। আমি মিথ্যা বলিনি। ফজলুল হক বলেছে কি না, আমি জানি না।’

টাঙ্গাইলের সখীপুরে যে তিনজনের সম্মানী ভাতা বন্ধ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন উপজেলার মহানন্দপুর গ্রামের আবদুর রশিদ ভূঁইয়া, বড়চওনা গ্রামের ইয়ার মাহমুদ এবং একই গ্রামের আবদুল হান্নান। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ওই উপজেলার শোলা প্রতিমা গ্রামের গাজী আবদুল কাদের মিয়া যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে আবদুল কাদেরের ওপর তাঁর বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আ. বছির মিয়া ও তাঁর লোকজন হামলা করেন। এ ঘটনায় দুই পক্ষ সখীপুর থানায় পাল্টাপাল্টি মামলাও করে। গত ২৯ নভেম্বর গাজী আবদুল কাদের মিয়া তাঁর বড় ভাই মো. আ. বছির মিয়া মুক্তিযোদ্ধা নন বলে জামুকার চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও জামুকার চেয়ারম্যান গত ২২ সেপ্টেম্বর ও ২৯ সেপ্টেম্বর বিষয়টি তদন্ত করেন। সশরীর হাজির হয়ে ভাতা বন্ধ হওয়া ওই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা তদন্ত কমিটির কাছে মো. আ. বছিরের পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দেন। এই অভিযোগে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রশিদ ভূঁইয়া ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়ার মাহমুদের তিন মাসের এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নানের দুই মাসের সম্মানী ভাতা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

আবদুর রশিদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মিথ্যা তথ্য দিইনি। যা বলেছি সত্য বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মো. আ. বছির মিয়া গ্রাম্য চিকিৎসক ছিলেন। তিনি মহানন্দপুর মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে গুলি খাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলমের চিকিৎসা করেছিলেন। এ কথাগুলোই ওই দিন মন্ত্রী ও জামুকার চেয়ারম্যানের কাছে বলেছিলাম। এখন আমাদের তিনজনকে মিথ্যাবাদী বানিয়ে ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভাতা চালু না করলে রিট করব।’

মো. আ. বছির মিয়া নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাইয়ের অভিযোগ ও ষড়যন্ত্রের কারণে আমার মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল হয়েছে। আমি এ বিষয়ে আপিল করব।’

একইভাবে সম্মানী ভাতা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের এস এম শহীদুল্লাহর। তিনি একই উপজেলার আবুল কাশেমের পক্ষে অসত্য সাক্ষ্য দেন বলে অভিযোগ। এই উপজেলার সার্জেন্ট নুরুল হক অভিযোগ করেছিলেন, আবুল কাশেম মুক্তিযোদ্ধা নন। মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার ফজলুল হক ও ইয়াকুব আলীর সম্মানী ভাতাও দুই মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

জামুকার মহাপরিচালক জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকে অর্থ লেনদেনের বিনিময়ে সাক্ষ্য দিতে আসেন, যা খুবই দুঃখজনক। আমরা শুনানি করে বুঝতে পারি, কে সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না। একই অপরাধ যদি কেউ দুইবার করেন, তবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।’