মা-বাবার কান্না যেন থামার নয়

বৃহস্পতিবার ট্রাকচাপায় নিহত হয় স্কুলশিক্ষার্থী শেখ নাঈম। ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যান মা নাজমা বেগম। গতকাল দুপুরে ফরিদপুর সদরের গদাধর এলাকায়
ছবি: আলীমুজ্জামান

নাঈমদের বাড়ি ফরিদপুর সদরের আলিয়াবাদে। ইউনিয়নের কাদেরের বাজার থেকে পূর্ব দিকে পদ্মার পাড় দিয়ে চলে গেছে একটি মেঠো পথ। সেই পথ ধরে এগিয়ে গেলে নদীর তীরেই নাঈমদের টিনের ছাউনির চৌচালা ঘর।

তার পুরো নাম শেখ নাঈম। বয়স ১৩ বছর। বিদ্যালয় ছুটির পর সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ফেরার পথে গত বৃহস্পতিবার ট্রাক্টরের চাপায় প্রাণ হারায় সে। গতকাল শুক্রবার নাঈমদের বাড়ির কাছে যেতেই শোনা গেল তার মা নাজমা বেগমের (৪৮) আহাজারি, ‘ওরে বাজান, আমার বাজান চইলা গেল রে। আমার বাজানরে আইনা দে।’

নাঈমের মতো আফরিন ও রিহানও ছোট্ট শিশু। আফরিনের বয়স ৭। রিহানের ৫। তারাও গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তাদের বাড়িতেও চলছে মাতম। মায়েদের আহাজারি, বাবাদের কান্না আর স্বজনদের চোখের পানি যেন থামার নয়।

বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সড়কে প্রাণ দিয়েছে ১ হাজার ১২ জন। এর মধ্যে শিশু মারা গেছে ১৩০টি। মার্চে শিশু মারা গেছে ৯৬টি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হিসাবে মার্চে সড়কে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে এসব শিশুর মৃত্যু শুধু একটি সংখ্যা। কিন্তু মায়ের কাছে তারা নাড়িছেঁড়া ধন। বাবার কাছে কলিজার টুকরা।

যেমন নাঈমের বাবা শেখ সেকেন (৫৬) পেশায় দিনমজুর হলেও ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন। যেন কোনো ঘাটতি না হয়, সেদিকেও নজর ছিল তাঁর। তিনি প্রথম আলোকে বলছিলেন, ছেলেকে যেন তাঁর মতো দিনমজুরি করতে না হয়, সেই চেষ্টাই করতেন তিনি। কিন্তু মাত্র ১৩ বছর বয়সে ছেলেটিকে সড়কে হারাতে হলো।

নাঈম তিন ভাইবোনের মধ্যে ছিল সবার ছোট। সে ছিল উপজেলার গেরদা ইউনিয়নের এ এফ মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।

তার বড় ভাই নাজমুল শেখ (২২) ফরিদপুরে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্স স্কুল থেকে মেডিকেল ডিপ্লোমা পাস করে বর্তমানে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছেন। বোন লামিয়া আক্তার (২০) বিবাহিত, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে ভূগোল বিষয়ে স্নাতক পড়ছেন।

নাঈমদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সে যে ঘরে থাকত, সেই ঘরের ভেতরটা টিস্যু পেপার, শপিং ব্যাগ, কাগজ দিয়ে বানানো ফুলসহ নানা উপকরণ দিয়ে সাজানো। পরিবারের সদস্যরা জানান, অবসরে এসব তৈরি করত নাঈম। বাড়িতে কবুতর পুষত। একটা পোষা বিড়ালও রয়েছে। উঠানের কতবেলগাছটাও নাঈমের লাগানো। এক বছর আগে হাট থেকে ১২০ টাকা দিয়ে কিনে এনেছিল। গোয়ালঘরের পাশে নয়নতারা ফুল আর একটি পেয়ারাগাছও লাগিয়েছিল কয়েক দিন আগে।

শেখ নাঈম

নাঈমের বাবা শেখ সেকেন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দুপুরে শুনলাম, আমার ছেলে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। সবার কাছে জানতে চাইলাম, ও কোথায় আছে। সবাই বলে হাসপাতালে আছে। তখনই আমি বুঝে যাই, আমার ছেলে আর বাঁইচা নাই।’

নাঈমের মরদেহ বৃহস্পতিবার রাতে দাফন করা হয়। তার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নাঈম অত্যন্ত ভদ্র ও মেধাবী ছাত্র ছিল। বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করা প্রয়োজন। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানানো হয়েছে। নাঈমের লাগানো নয়নতারাগাছে আর কিছুদিন পরেই ফুল ফুটবে। নাঈমের মায়ের কাছে তাঁর ‘বাজান’কে আর কেউ ফিরিয়ে দেবে না।

আফরিন বলেছিল, ‘বাবা, তুমি কেঁদো না’

আফরিন হক

বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে স্কুলে যাওয়ার পথে রাজশাহী নগরের খড়খড়ি বাইপাসের বামনশিখড় এলাকায় বুধবার সকালে ট্রাকচাপায় আহত হয় আফরিন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা দিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি।

আফরিনের মরদেহ বৃহস্পতিবার রাতে দাফন করা হয়েছে। গতকালও রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের হাট রামচন্দ্রপুর গ্রামে আফরিনদের বাড়িতে ছিল স্বজন ও প্রতিবেশীদের ভিড়। তার বাবা আজিজুল হক প্রতিবেশী ও স্বজনদের হাসপাতালের শয্যায় থাকা আফরিনের ছবি দেখাচ্ছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, ‘ঢাকায় হাসপাতালে নেওয়ার পর আফরিন আমাকে কাঁদতে দেখে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল, “বাবা, তুমি কেঁদো না, আমি ভালো হয়ে যাব।”’

আফরিনের দুর্ঘটনার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত তার মা মাসুরা বেগম কোনো খাবার খাননি। স্বজনেরা বলেন, তাঁরা অনেকেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। বিলাপ করতে করতে আফরিনের মা বলছিলেন, তাঁর আদরের ধন নেই। কী খাবেন, কী করবেন।

চিকিৎসাধীন থাকার সময় আফরিনের কাছে ছিলেন তার দুই ফুফু। বড় ফুফু গোলাপজান প্রথম আলোকে বলেন, গত ৯ মার্চ আফরিনের জন্মদিন ছিল। আফরিন তাঁর কাছে বায়না ধরে বলেছিল, জন্মদিনে তিন পাউন্ডের কেক লাগবে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের দিন সে মা-বাবা, দাদা-দাদিকে পাশে বসিয়ে ছবি তুলেছে। ছবির ফ্রেম ঠিক করার জন্য বলেছে, ‘এভাবে বসো, ওভাবে বসো।’ এরপর গোলাপজানের কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসে। তিনি আর কিছুই বলতে পারেননি।

আফরিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা দপ্তরের অফিস সহায়ক। আফরিনরা দুই বোন। সে ছিল বড়।

পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার পর আফরিনের পা কেটে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাকে বাঁচানো যায়নি।

আফরিনদের বাড়িতে যাওয়ার আগে গতকাল সকালে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কয়েকজন শ্রমিক মাটিকাটার কাজ করছেন। বুধবার সকালেও তাঁরা একই কাজ করছিলেন। তাঁদের চোখের সামনেই দুর্ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের মধ্যে আনারুল ইসলামসহ কয়েকজন দুর্ঘটনার পর আফরিনকে রক্তাক্ত অবস্থায় ভ্যানগাড়িতে তুলে দেন। আনারুল প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার সময় ট্রাকটি শিশুটির পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। পরে একটু সামনে যাওয়ার পর ঘাবড়ে গিয়ে চালক ও সহকারী পালিয়ে যান। তাঁরা আফরিনকে ভ্যানে তোলার জন্য তাঁদের ডেকেছিলেন। কিন্তু তাঁরা না শুনে পালিয়ে যান।

ছোট্ট রিহানের জন্য কান্না

রিহান মিয়া

গ্রামের রাস্তা দিয়ে ফুফুর সঙ্গে হাঁটছিল ছোট্ট রিহান। এ সময় হঠাৎ করে একটি বিদ্যুৎ-চালিত অটোরিকশা এসে ধাক্কা দেয় তাকে। এরপর পড়ে যাওয়া রিহানকে চাপা দেয় অটোরিকশাটি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ ঘটনার পর রিহানকে আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় গ্রামের মসজিদে জানাজা শেষে তার মরদেহ দাফন করা হয়।

রিহান আখাউড়া উপজেলার আখাউড়া উত্তর ইউনিয়নের রাজপুর গ্রামের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীরের ছেলে। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে রিহান সবার ছোট।

রিহানের বাবা জাহাঙ্গীর কৃষিকাজ করে সংসার চালান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রিহানই ছিল তাঁর সবচেয়ে আদরের সন্তান।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রবীর কান্তি বালা, ফরিদপুর, শফিকুল ইসলাম, রাজশাহী, শাহাদৎ হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া]