‘মা কেবল মা...’

বিশেষ কায়দায় সন্তানকে নিজের সঙ্গে রেখে ডানা ত্রিপুরার ক্লাস নেওয়ার এই ছবি ফেসবুকে অনেকের নজর কেড়েছে
ছবি: সংগৃহীত

রেনেসাঁস যাপ্রি ত্রিপুরার বয়স তিন বছর। আলেক্সিস সাঁপ্রি ত্রিপুরার বয়স মাত্র সাত মাস। এই দুই মেয়ের মা ডানা ত্রিপুরা বান্দরবানের আলীকদমে চমপট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। স্বামী আব্রাহাম ত্রিপুরা আর দুই মেয়েকে নিয়েই ডানার সংসার।

তাই দুই মেয়ে, বিশেষ করে ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই স্কুলে যেতে হয় ডানাকে। ঘুমে থাকলে কাপড়ে বেঁধে মেয়েকে বুকের কাছে ঝুলিয়ে রাখেন। অথবা স্কুলের যে শিক্ষকের ক্লাস থাকে না, সেই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে রেখে ক্লাসে যান ডানা। অনেক সময় শিক্ষকদের রুমে ফ্লোরে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন। এভাবেই সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত স্কুলের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন এই মা।

দুই শিশুসন্তানের সঙ্গে মা ডানা ত্রিপুরা

মেয়েকে কোলে নিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন—এমন একটি ছবি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে ডানা লিখেছেন, ‘মা কেবল মা...’। তাঁর এই পোস্ট নিয়ে ফেসবুকে বেশ আলোচনা হয়। সন্তানের জন্য মায়েরা কীভাবে যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেন অনেকে। ডানা ত্রিপুরার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন তাঁরা।

এরপর বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার টেলিফোনে কথা হয় ডানা ত্রিপুরার সঙ্গে। এই মা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো কিছু ভেবে ছবি পোস্ট করিনি। আমরা মায়েরা বাচ্চা পালতে পারি, একইভাবে পেশাগত দায়িত্বও পালন করতে পারি। আর পাহাড়ে জন্ম যে নারীদের, তাঁরা বাচ্চা কোলে নিয়ে এর চেয়েও কঠিন কঠিন কাজ করতে পারেন। আমাকে আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে অন্য শিক্ষকেরাও সার্বিক সহায়তা করছেন। অন্য নারী শিক্ষকেরাও প্রয়োজন হলে বাচ্চাকে সঙ্গে আনেন। তবে এত ছোট বাচ্চা এখন আমারই আছে।’

ডানা জানালেন, তাঁর বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব হাঁটাপথে পাঁচ মিনিট লাগে। বাসায় মেয়েকে দেখভাল করবেন তেমন কেউ নেই। দীর্ঘ সময়, তাই সন্তানের নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হয়। ব্যবসায়ী স্বামী একসঙ্গে দুই মেয়েকে সামলাতে পারেন না। তাই হয় বড়, নাহয় ছোট মেয়—একজনকে সঙ্গে রাখতেই হয়। এলাকায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকলে তাঁর মতো কর্মজীবী নারীদের সুবিধা হতো বলে মনে করেন ডানা।

শিশুসন্তানকে সঙ্গে রেখে ক্লাসে পড়াচ্ছেন ডানা ত্রিপুরা

২০১৫ সালে বিয়ে করেন ডানা ত্রিপুরা। তিনি এসএসসি পাস করেছেন কক্সবাজারের রামু থেকে। এরপর রাজধানীর এমসিইটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (আর্কিটেকচার) করেছেন। এরপর গত ৯ বছর ধরে স্কুলটিতে শিক্ষকতা করছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বামীর পাহাড়ি মধু ব্যবসা উদ্যোগে সহায়তা করছেন। কেন্দ্রবিন্দু নামের একটি সংগঠনের তাঁতিদের বানানো বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন। কল্পপুরী স্কুল অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটসে দৃশ্যকলা বিভাগের সহকারী শিক্ষক হিসেবে শুক্রবার ক্লাস নেন।

ডানা জানালেন, বড় মেয়ে যখন ছোট ছিল, সে সময় তাঁর কাজ করতে তেমন সমস্যা হয়নি। তখন তিনি তাঁর মা–বাবার সঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। এখন আলাদা বাসায় থাকেন। তাঁর মা–ও কর্মজীবী নারী। মা, ননদ বা বাসায় বাচ্চাদের দেখার মতো কেউ থাকলে তখন বাচ্চাদের বাসায় রেখেই কাজের সুযোগ পান ডানা।

মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেলে কাজের কোনো ব্যাঘাত ঘটে কি না, জানতে চাইলে হাসতে হাসতে ডানা বললেন, ‘বেশির ভাগ সময়ই মেয়ের সারা দিনের খাবারসহ গাট্টি–বোঁচকা বেঁধে রওনা দিতে হয়। বাচ্চা, তাই সব সময় চুপ করে তো আর থাকে না। বেশি বিরক্ত করলে ক্লাসের বাচ্চাদের কাছ থেকে মাঝেমধ্যে একটু সময় চেয়ে নিয়ে বাচ্চাকে সামলানোর চেষ্টা করি। বাসায় কেউ থাকলে তাঁকে এসে নিয়ে যেতে বলি।’

করোনার সময় শিক্ষার্থীদের স্কুল বন্ধ থাকলেও শিক্ষকদের নানা কাজে স্কুলে যেতে হয়েছে। তখনো মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই স্কুলে গেছেন ডানা। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস শুরু হয়েছে। মেয়েদের নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ডানা বললেন, ‘আমি যখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন বড় মেয়েকে হাতে ধরে স্কুলের শিশু জরিপের কাজও করেছি। পেশাগত দায়িত্ব পালনে কখনো অবহেলা করিনি। তবে যেহেতু আমি মা, তাই সব সময় আমার মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়।’

জিয়াউল হক খুব অল্প কদিন হলো চমপট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। টেলিফোনে তিনি প্রথম আলোকে জানালেন, স্কুলটিতে মোট শিক্ষার্থী ৪৩১ জন। মেয়েকে নিয়ে ডানা ত্রিপুরার স্কুলে আসা প্রসঙ্গে বললেন, ‘এ ধরনের সমস্যা শুধু তিনি কেন, যে কারও বেলাতেই হতে পারে। সমস্যা থাকলে তার সমাধানও তো করতে হবে। আর ডানা ত্রিপুরা স্কুলের কাজের বেলায় খুব আন্তরিক। তাঁর বাসায় এ বাচ্চাকে দেখে রাখার কেউ নেই। বলা যায়, স্কুলের আমরা দুজন পুরুষ শিক্ষকসহ মোট সাতজন শিক্ষক মিলেই বাচ্চাকে সামলাচ্ছি।’

জিয়াউল হক বললেন, বাচ্চা নিয়ে ক্লাসে গেলে অন্য বাচ্চাদের মনোযোগ নষ্ট হতে পারে। তাই ডানা ত্রিপুরাকে পরামর্শ দিয়েছেন, ক্লাসের সময় খুব বেশি প্রয়োজন না হলে সে সময় যে শিক্ষকের ক্লাস থাকবে না, তাঁর কাছে যাতে রেখে আসেন।
এই প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘মেয়েটির বয়স অন্তত এক বছর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সহায়তা করতেই হবে।’

ডানা ত্রিপুরা গত বছর মধু ব্যবসার উদ্যোগ নিয়ে ফেসবুকে ১২ লাখের বেশি সদস্যের প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। উইয়ের সভাপতি নাসিমা আক্তার (নিশা) প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছবিটাই বলে দিচ্ছে, মা মানেই মা। তিনি মায়ের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্বপ্ন পূরণের কাজও করে যাচ্ছেন। তবে সন্তানের বেলায় কোনো ছাড় দিচ্ছেন না। ভাবা হয়, সন্তানের জন্মের পর নারীদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়, এই নারীর ক্ষেত্রে তা হয়নি। পরিবার ও কর্মক্ষেত্রের সহায়তা পাচ্ছেন বলেই তিনি সব সামলাতে পারছেন। বান্দরবান থেকে অনলাইনে তিনি উইয়ের বিভিন্ন কোর্স, প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যবসায়ী হতে গেলে যা যা প্রয়োজন, তাতে উই সার্বিকভাবে সহায়তা করছে।’

উইয়ের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা প্রধান এবং মডারেটর শিরিন সুলতানা নিজেদের ফেসবুক গ্রুপে ডানা ত্রিপুরার প্রশংসা করে একটি পোস্ট দিয়েছেন। নারীরা যে সব পারে, তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে ডানা ত্রিপুরার কথা তুলে ধরেছেন তিনি।