মায়ের কান্না থামছে না

বুয়েট শিক্ষার্থী নিহত আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুনের কান্না থামছেই না। রায়ডাঙ্গা গ্রাম, কুমারখালী, কুষ্টিয়া, ১০ অক্টোবর। ছবি: তৌহিদী হাসান
বুয়েট শিক্ষার্থী নিহত আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুনের কান্না থামছেই না। রায়ডাঙ্গা গ্রাম, কুমারখালী, কুষ্টিয়া, ১০ অক্টোবর। ছবি: তৌহিদী হাসান

ছেলেকে হারিয়েছেন চার দিন হয়ে গেছে। মনের ভেতরের বেদনা কী করে বোঝাবেন আবরারের মা রোকেয়া খাতুন। স্বজনেরা খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক দানা ভাত মুখে যেন ঢুকছেই না তাঁর। ছেলে হারানোর বেদনায় দুঃখিনী মায়ের মুখে খাবার রোচে না।

আবরার যেদিন (রোববার) সকাল সাড়ে নয়টায় ঢাকায় যান, সেদিন মা নিজ হাতে চালের রুটি ও গোশত রেঁধে ব্যাগে দিয়েছিলেন। সেই খাবারের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন রোকেয়া খাতুন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সকালে নিজ হাতে জামা আয়রন করে পরিয়ে দিয়েছিলাম। চালের রুটি ও গোশত রেঁধে ব্যাগে দিয়েছিলাম। নিজে রিকশা নিয়ে ছেলেকে বাসে উঠায় দিলাম। ঘণ্টায় ঘণ্টায় খোঁজ নিচ্ছি, বাবা কত দূর। সেই বাবা আমার দূরে চলে গেল। রুটি-গোশত খেতে পেরেছিল কি না জানি না। সেই ছোট্ট থেকে ২২ বছর ধরে ছেলেকে বুকে আগলে রেখেছিলাম।’

বৃহস্পতিবার দুপুরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার রায়ডাঙ্গা গ্রামে আবরারদের বাড়িতে তাঁর মায়ের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন। গ্রামবাসীও ভুলতে পারছেন না আবরারের নৃশংস হত্যার কথা। দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাঁরা হতবিহ্বল।

কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে বড় বাজারের পাশেই গড়াই নদের ঘট্টিয়া ঘাট। প্রায় ৮০০ মিটার নৌকা পাড়ি দিয়ে দেড় কিলোমিটার পরেই আবরারদের রায়ডাঙ্গা গ্রাম। বিশ্বাসবাড়ির সন্তান আবরার। গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত এই পরিবারের সদস্যরা। রায়ডাঙ্গা গ্রামের পাশের গ্রামের নাম কয়া। এই কয়াতে দীর্ঘ কয়েক বছর ছিলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন। গ্রামের মাঝ দিয়ে পাকা সড়ক। দুই পাশে পাকা ও আধা পাকা বাড়িঘর। আবরারদের বাড়ির সামনে বাহারি গাছগাছালিতে সুবজে ভরা। এখন প্রতিদিনই আবরারের আত্মীয়স্বজন ও অচেনা মানুষ বাড়িতে ভিড় করছেন। মা-বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

রোকেয়া খাতুনের একটাই চাওয়া, ‘আমার ছেলেকে যারা আমার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরিয়ে দিল, তারাও যেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরতরে (বহিষ্কার) চলে যায়। ছেলেকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’ তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজ পর্যন্ত মা-বাবার অধীনে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তখন ভিসির হয়ে যায়। সেই ভিসির কাছে ছেলেকে দিয়েছিলাম। কিন্তু ছেলেটা পড়ে থাকলেও সেই ভিসি দেখতেও আসেননি। জানাজায় অংশও নেননি। ঢাকা থেকে এসে আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে গেছে।’

যে ভিসি তাঁর ছেলেকে নিরাপত্তা দিতে পারেননি, বাকি ছেলেদের কীভাবে নিরাপত্তা দেবেন—এমন প্রশ্ন তুলে ছেলে হারানো এই মা বলেন, ‘দেশবাসী, এমনকি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা আবরার হত্যার বিচারের জন্য মাঠে নেমেছে। সেই ছেলেদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।’

আবরারের মা-বাবা উভয় স্নাতকোত্তর পাস। দুজনই একসময় কলেজের শিক্ষক ছিলেন। সাধারণভাবেই জীবন যাপন করেন তাঁরা। রোকেয়া বলেন, দুই ছেলেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এক ছেলের সেটা হলো না। এখন একমাত্র ভরসা ছোট ছেলে আবরার ফাইয়াজ। সেই ছোট ছেলেকে যেন মানুষ করতে পারেন, তাঁর জন্য নিরাপত্তা চান। কারণ, খুনিদের আত্মীয়স্বজন আছে, তারাও ছোট ছেলের ক্ষতি করতে পারে।

ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। রায়ডাঙ্গা গ্রাম, কুমারখালী, কুষ্টিয়া, ১০ অক্টোবর। ছবি: তৌহিদী হাসান

বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে চেয়ারে বসেছিলেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। এককথায় তিনি বললেন, ‘আমার ছেলের জন্য সারা বাংলা কাঁদছে। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’ একই সঙ্গে অমিত সাহা গ্রেপ্তারের খবরে তিনি স্বস্তি পেয়েছেন।

ছেলে নিহত হওয়ার খবর পেয়ে ভোরেই ছুটে গিয়েছিলেন বুয়েটে। এক মিনিটের জন্য ছেলের কক্ষে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল বাবার। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পোশাক ও বইপত্র দেখেছিলেন। শোয়ার চৌকির নিচে থাকা ট্রাংকসহ অন্য জিনিসপত্র স্পর্শ করে ছেলের স্পর্শ অনুভব করতে চেয়েছিলেন বাবা। কিন্তু পুলিশের বাধার কারণে তা ছুয়ে দেখতে পারেননি। ছেলের শেষ স্মৃতিগুলো পেলে ভালো লাগত বলে জানান বরকত উল্লাহ। বলেন, ছেলের মোবাইল ফোন প্রভোস্ট রেখেছিলেন। কিন্তু ল্যাপটপটি কোথায় আছে তা জানেন না।

ছেলেহারা এই বাবা বলেন, তাঁর ছেলে সারা বাংলার সন্তান। সবাই তাঁর জন্য কেঁদেছে, এটুকু সান্ত্বনা। সরকার ও প্রশাসন এখন পর্যন্ত যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে তিনি আশ্বস্ত। বুয়েটের ছেলেমেয়েরা যে দাবিতে আন্দোলন করছেন, সেসবের সঙ্গে তিনি একমত। তাঁর ছেলেকে নিয়ে কোনো রাজনীতি না করার অনুরোধ জানান তিনি।

মা-বাবার সঙ্গে আবরারের ছোট ভাই ফাইয়াজও ভীষণ ভেঙে পড়েছে। ঢাকা কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র সে। বড় ভাইয়ের সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল তাঁর।