চিপস, চানাচুর, বিস্কুট, ভাজা মটর ও ডাল, দুধের চকলেট, আইসক্রিম, ললিপপ বা লজেন্স, চাটনি, ফ্রাইড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কোমল পানীয় এবং এনার্জি ড্রিংক—শিশু, কিশোর ও তরুণদের পছন্দের তালিকায় এই খাবারগুলো থাকবেই। তবে দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া এসব খাদ্যপণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান পেয়েছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, বেশি দামে বাজে জিনিস খাচ্ছে মানুষ।
ব্যবসায়ীদের নীতির ক্ষেত্রে চতুরতা আছে, তাঁরা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন।
বাজারে বেশি বিক্রি হওয়া ৯টি প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্য, ৫টি ব্র্যান্ডের ফ্রায়েড চিকেন ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং ১০টি ভিন্ন কোম্পানির কোমল পানীয় এবং ৫টি কোম্পানির এনার্জি ড্রিংক নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি তিনটি গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় চিকিৎসকদের পাশাপাশি পুষ্টিবিজ্ঞানীরাও যুক্ত ছিলেন। ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এই তিনিটি গবেষণা করা হয়।
চিকিৎসকেরা বলছেন, ফাস্ট ফুড নিয়মিত খেলে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। আর দেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশের কারণ অসংক্রামক রোগ।
তিনটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ সোমবার বিএসএমএমইউতে ‘স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ: বাংলাদেশের বাজারে সহজলভ্য স্ন্যাকস এবং পানীয়র উপাদান বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক সেমিনার আয়োজন করা হয়।
সেমিনারে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এই গবেষণা কারও বিরুদ্ধে না বা এমন কিছু বলা হচ্ছে না যে ফাস্ট ফুড খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। তবে পরিমাণ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা ভাবতে হবে।
বর্তমান জীবনযাপনে প্রক্রিয়াজত খাবারে মানুষ ভীষণভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলে জানান ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক খন্দকার আবদুল আউয়াল। তিনি বলেন, এসব গ্রহণে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবারে লবণ, চিনি ও চর্বির পরিমাণ মূল্যায়ন এবং খাদ্যপণ্যের মোড়কে (চিপস, চানাচুর, বিস্কুটসহ অন্যন্য) দেওয়া তথ্য আর বাস্তবতা কী, এ নিয়ে করা গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সহকারী অধ্যাপক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন।
এ গবেষণার জন্য আটটি বিভাগের ২৪টি বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালরি, লবণ, চিনি, স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড ও ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডের সঠিক পরিমাণ কোনো পণ্যেই পাওয়া যায়নি। ৭০ শতাংশের বেশি নমুনায় কার্বোহাইড্রেট বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ১০০ গ্রাম লজেন্স বা ললিপপ, ভাজা মটর বা ডাল ও দুধের চকলেটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের তুলনায় দৈনিক গ্রহণযোগ্য চিনি, লবণ ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে।
পাঁচটি ব্র্যান্ডের ফ্রাইড চিকেন ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে কি না, এ–সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন সেমিনারে তুলে ধরেন বিএসএমএমইউর চিকিৎসক সাজিয়া ইসলাম। তিনি বলেন, ১০০ গ্রাম ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের মধ্যে শূন্য দশমিক ৪৫ গ্রাম এবং একই ওজনের ফ্রাইড চিকেনে শূন্য দশমিক ৪৬ গ্রাম সোডিয়াম পাওয়া গেছে। যা মানুষের দৈনিক অনুমোদিত মাত্রার (সোডিয়াম গ্রহণ) চার ভাগের এক ভাগ।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ে আর্সেনিক পাওয়া গেছে দশমিক শূন্য ৯৩ মিলিগ্রাম। একবারে একজন মানুষ গড়ে ১০০ গ্রাম ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেলে তা অনুমোদিত মাত্রার (আর্সেনিক) ৪২ শতাংশের বেশি খাওয়া হবে। এ ছাড়া ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ে ট্রান্সফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া গেছে দশমিক ১১ গ্রাম ও সিসার পরিমাণ ছিল দশমিক শূন্য শূন্য ৩ মিলিগ্রাম। এক বসায় ১০০ গ্রামের বেশি ফ্রাইড চিকেন খেলে দিনে আর্সেনিক ও সিসার অনুমোদিত মাত্রার ৩ শতাংশ গ্রহণ করা হয়ে যায়।
উচ্চমাত্রার সোডিয়াম, ট্রান্সফ্যাট, সিসা শরীরের প্রবেশ করলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, বিষণ্নতা, স্ট্রোক, ক্যানসারের কারণ হতে পারে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়।
তৃতীয় গবেষণাটি ছিল কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান নিয়ে। এই গবেষণার ফলাফল সেমিনারে তুলে ধরেন বিএসএমএমইউর চিকিৎসক এ এইচ এম গোলাম কিবরিয়া। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় তিন–চতুর্থাংশ পানীয়ের ‘পিএইচ’ মাত্রা পাওয়া গেছে ৩–এর নিচে, যা দাঁতের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী, একজন মানুষ দিনে সর্বোচ্চ ২৫ গ্রাম চিনি গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু সংগৃহীত নমুনার কোমল পানীয়তে (২৫০ মিলিগ্রাম) ২০ দশমিক ৮ থেকে ২৮ দশমিক ৮ গ্রাম চিনি এবং এনার্জি ড্রিংকে ২২ দশমিক ৬ থেকে ৩৭ গ্রাম চিনির উপস্থিতি রয়েছে। এনার্জি ড্রিংকে ক্যাফেইনের মাত্রা বেশি। এ ছাড়া কোমল পানীয়তে দশমিক শূন্য ৫৩ মিলিগ্রাম এবং এনার্জি ড্রিংকে দশমিক শূন্য ৪৮ মিলিগ্রাম সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাজারে বিক্রি হওয়া পানীয় পান করার কারণে শিশুদের স্থূলতা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে।
প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার, ঠান্ডা পানীয় ও ফাস্ট ফুড ভালো না—শুধু মুখে মুখে এসব কথা না বলেও খাবার গ্রহণে সচেতনতা দরকার বলে সেমিনারে উল্লেখ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, এই গবেষণায় উঠে আসা ফলাফল মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারলে হয়তো পরিবর্তন আসবে।
সেমিনারে প্যানেল আলোচনায় খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। আলোচকেরা বলেন, এসব খাদ্যে ভারী ধাতব পদার্থের উপস্থিতি কীভাবে আসছে, তা ভাবার বিষয়। খাদ্যের গুণগত মান ঠিক করতে সরকারের উদ্যোগ দরকার।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক (খাদ্যের বিশুদ্ধতা পরিবীক্ষণ ও বিচারিক কার্যক্রম বিভাগ) সহদেব চন্দ্র সাহা বলেন, এনার্জি ড্রিংকসের অনুমোদন বাংলাদেশে নেই। বাজারে এগুলো কীভাবে এল, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের নীতির ক্ষেত্রে চতুরতা আছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) উপপরিচালক এনামুল হক। তিনি বলেন, দেশের শীর্ষ পাস্তুরিত দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মান বেঁধে দিতে গেলে তারা মানতে রাজি হয় না। সরকারের বেঁধে দেওয়া মান থেকে বের হয়ে নিজেরাই মান ঠিক করে তারা। প্রতিষ্ঠানগুলো লো ফ্যাট মিল্ক, ফ্যাট ছাড়া মিল্কসহ বিভিন্ন নামে পণ্য বাজারজাত করে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করছে। তারা দাম বেশি নিক কিন্তু মানসম্পন্ন পণ্য উপৎপাদন করুক। পৃথিবীর কোথাও এই অনাচার নেই। কোনো মান নিয়ে সরকার কঠোর হলে তখন ব্যবসায়ীরা এ রকম করে। বাজারকে তাঁরা নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, এই গবেষণা দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। গবেষণার ভিত্তিতে ভালো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়। তথ্য তুলে নিয়ে এলে তা নীতি পর্যায়ে যায়। তবে মান নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে।
ফ্রায়েড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ঠান্ডা পানীয় নিয়ে গবেষণা দলের তত্ত্বাবধায়ক গবেষক বিএসএমএমইউর সহযোগী অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান ও প্রক্রিয়াজাত প্যাকেটজাত খাবার নিয়ে গবেষণা দলের প্রধান গবেষক ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী সেমিনার সঞ্চালনা করেন। আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, বিএসএমএমইউর সহ–উপাচার্য জাহিদ হোসেনসহ প্রমুখ।