মানালিতে স্বপ্ন পূরণ

সময় সুযোগ পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন নাফিসা আবেদীন কথা।
সময় সুযোগ পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন নাফিসা আবেদীন কথা।

সবে নতুন জীবনের শুরু। নিভৃত ভালো লাগা, ভালোবাসায় কটা দিন। শুধু দুজনে...এবারে আমাদের দুজনার স্বপ্নের স্বর্গভূমি সিমলা-মানালি যেতে হবে, যেভাবেই হোক। যেই ভাবা, সেই কাজ। প্রথমে কলকাতা, সেখান থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে কাল্কা। কু-ঝিক ঝিক শব্দ তুলে এগিয়ে চলা টয় ট্রেনে জীবনে প্রথমবারের মতো চেপে প্রায় ছয় ঘণ্টা পর পৌঁছালাম হিমাচল প্রদেশের রাজধানী শহর ‘পাহাড়ের রানি’ সিমলায়। প্রায় ৯৬ কিলোমিটার যাত্রা পথে ১০৩টি টানেল পেরোনোর রোমাঞ্চ তো আছেই, সঙ্গে উপরি পাওনা সারা পথের অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য। সিমলা শহরটি আপার, মিডল ও লোয়ার—তিনটি স্তরে সাজানো। আপার মলের প্রাণকেন্দ্র স্কান্ডাল পয়েন্টে অবস্থিত পুরোনো ধাঁচে গড়া একটা হোটেলে উঠলাম। পরদিন সকালে জানালা খুলতেই সে এক অপূর্ব দৃশ্য—উন্মুক্ত আকাশ, শান্ত স্তব্ধতা। হোটেল থেকে বেরিয়ে উদার পাহাড়ের বুকে মেঘের সঙ্গে মোকাবিলায় উপভোগ করলাম ব্রিটিশ আমলের ইউরোপীয় স্থাপত্যে নির্মিত বহু দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা যেগুলো তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

টয় ট্রেনে চেপে হিমাচলের রাজধানী সিমলায় যাওয়ার আনন্দ অনেক । শহরটিকে ‘পাহাড়ের রানি’ বলা হয়।

চোখ জুড়ানো তরঙ্গায়িত পাহাড়ের গা বেয়ে মনের আনন্দে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম দেড় শ বছরের প্রাচীন কালীবাড়িতে। শ্যামলা দেবীর মূর্তি অধিষ্ঠিত আছে এই কালীবাড়ীতে। কথিত আছে, শ্যামলা দেবীর নাম থেকেই এই পাহাড়ি শহরের নাম হয়েছে সিম্লা। সিমলা পাহাড়ের সর্বোচ্চ স্থান হল ‘জাসু হিলমের চূড়া’। কিংবদন্তি অনুসারে, লক্ষ্মণকে বাঁচাতে সঞ্জীবনী ঔষধি সন্ধানরত বীর হনুমান নাকি এখানেই অবতরণ করেছিল। এই হনুমানজির এক বংশধরের হাতে আমার হ্যাটটি বিসর্জন দিয়ে আরেকটু হেঁটে পৌঁছালাম স্টেট মিউজিয়ামে। প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষের সংগৃহীত প্রাচীন মূর্তি, চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র প্রভৃতির এক অসাধারণ সংগ্রহশালা এই জাদুঘর। এভাবেই কেটে গেল পুরো একটা দিন।

বিপাশা নদীর তীরে লেখক।

পরদিন খুব ভোরে ভাড়া গাড়ি করে রওনা হলাম মানালির পথে। প্রায় আট ঘণ্টা পর পৌঁছালাম বিপাশা নদীর তীরে অবস্থিত শহর মানালিতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাক্কা ২০৫০ মিটার উচ্চতায়। পথে উপভোগ করলাম ঘন সবুজ মখমল-মসৃণ পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা বাড়িগুলো যেন কোনো শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দুচোখে অপার বিস্ময় নিয়ে প্রত্যক্ষ করলাম প্রকৃতির রঙের খেলা। ঝিম ধরা স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন সর্পিল পাহাড়ি ঝরনার পাশে চেস্টনাট- ম্যাপল, ওক-পাইনের ঘন সবুজ অভ্যর্থনা। এমনি করে কখন যে ২৮০ কিলোমিটার পার হয়ে গেল, বুঝতে পারলাম না। হোটেল আগে থেকেই রিজার্ভ করা ছিল। সেখানে ছিল ‘হিল ভিউ’-এর রুম থেকে পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ। খানিকটা বিশ্রাম নিয়েই গাড়ি ভাড়া করে নিলাম মানালি সাইট- সিয়িংয়ের জন্য, ফাইভ পয়েন্টস দেখব বলে।

প্রথমেই দেখলাম বৌদ্ধ গুম্ফা*। গুম্ফা হচ্ছে বৌদ্ধ উপাসনালয়। পাশেই দেবদারুগাছে ছাওয়া মনোরম পরিবেশে রয়েছে হিড়িম্বা মন্দির। তারপর সেখানকার একটি বাঙালি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সেরে চলে গেলাম মানালসু নদীর তীরে ক্লাব হাউসে। সেখানে বরফ গলা জলে পুষ্ট খরস্রোতা নদীতে চতুর্দিকে বিচিত্র গড়নের ন্যাড়া পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এরই মাঝে উচ্ছল মানালসুর অবিরাম নৃত্য ছন্দে বয়ে চলা। এরপর নেচার পার্ক আর ফোক মিউজিয়াম ঘুরে হোটেলে ফিরলাম।

নতুন জীবনের শুরুতেই অনেকেই ঘুরতে যান ভারতের মানালি, হিমাচল প্রদেশে।

রাতে খাবারের পর দুজনে গেলাম শপিংয়ে। মলে কুলুর বিখ্যাত শাল আর সোয়েটারের সারি সারি দোকান, পাহাড়ি মেয়েদের হাতে তৈরি বাহারি গয়না আর রকমারি জিনিসের পসরা। নিজের এবং সেই সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের জন্য কেনাকাটা এখানেই সারলাম। হোটেলে ফিরে সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিদ্রা দেবীর শরণ নিলাম।

অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল চেনা-অচেনা অনেক পাখির ডাকে। কাচঢাকা জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি বিস্তীর্ণ উপত্যকা প্রভাত সূর্যের আলোয় স্নাত। সোলাং ভ্যালি দেখতে যাব বলে তাড়াতাড়ি নাশতা সেরে বের হলাম। মানালি থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে সোলাং ভ্যালি সবুজ ঘাসের মখমলে ঢাকা এক দৃষ্টিনন্দন মনোরম উপত্যকা। সেখানে দেখলাম কেউবা পারাগ্ল্যাইডিং করছে, কেউবা আডভেঞ্চারাস স্পোর্টসের দেদার মজা নিচ্ছে। তার পরের দিন ফেরার পালা। ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে কালকার পথে...যে পথের একধারে সেই শান্ত স্তব্ধ পাহাড়ের সঙ্গে মিশে গেছে আকাশের নীল রং, যেখানে চারদিক ধূসর কুয়াশায় ঢাকা, যেখানে মেঘের ওপর আকাশ ভাসে। পথের আরেক ধারে কুলকুল শব্দে অবিরাম বয়ে চলা বিপাশা। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আমাকে করেছে নতজানু...আমি তৃপ্ত। আর তাইতো বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে মানালির ওই কোমল মৃত্তিকার পাহাড়ি পথে, যে ভালোবাসার পদচিহ্ন আমি রেখে এসেছিলাম বছর পাঁচেক আগে...আমার সেই পদচিহ্নের টানে।

*নাফিসা আবেদীন কথা, চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়