বিচারবহির্ভূত হত্যা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বন্ধে মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে হতাশা।
‘গুম’ ও ‘ক্রসফায়ারের’ মতো বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের দাবিতে জাতিসংঘের পাশাপাশি দেশি–বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো সব সময় সোচ্চার থাকলেও এ ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা অনেকটাই নীরব। বিচারবহির্ভূত হত্যা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বন্ধে বর্তমান কমিশনের পক্ষ থেকে জোরালো বা দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।
গত জুলাই মাসে টেকনাফে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলেও মানবাধিকার কমিশনের এ নিয়েও দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা ছিল না। অথচ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় তাদেরই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হওয়ার কথা।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক দুজন চেয়ারম্যান এবং মানবাধিকারকর্মীরা মনে করেন, জনগণের ভরসা ও আস্থার জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি মানবাধিকার কমিশন। বিশেষ করে বর্তমানে কমিশনের ভূমিকায় মানুষের আস্থার জায়গা আরও নড়বড়ে হয়ে গেছে। কমিশন স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান কমিশন তো মনে হয় কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। মানবাধিকারের কাজ তো সেখানেই, যেখানে আইনের শাসন লঙ্ঘিত হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে চুপ করে থাকতে পারে না। কমিশন যদি এসব না দেখে, তবে অন্য সাধারণ সংগঠনের সঙ্গে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের তফাত কীমিজানুর রহমান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
গত বছরের অক্টোবরে অবসরপ্রাপ্ত সচিব নাছিমা বেগমকে চেয়ারম্যান করে নতুন কমিশন গঠন করে সরকার। এই কমিশন গঠনের পর মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, মানবাধিকারসংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতা যাঁদের নেই, তাঁরাই নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছেন।
এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা ৪০ বছর সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করেছেন, তাঁরা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারবেন না। তাঁদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেছে।। কমিশন যদি মনে করে কিছু করলে বা কোনো বিবৃতি দিলে সরকার নাখোশ হবে, তাহলে সেখানেই মানবাধিকার কমিশনের মৃত্যু ঘটে।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান কমিশন তো মনে হয় কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। মানবাধিকারের কাজ তো সেখানেই, যেখানে আইনের শাসন লঙ্ঘিত হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে চুপ করে থাকতে পারে না। কমিশন যদি এসব না দেখে, তবে অন্য সাধারণ সংগঠনের সঙ্গে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের তফাত কী।’
এইচআরএফবির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এ বছরের ২৫ জুন পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৫৩৫ জন। এসব ঘটনার তদন্ত বা প্রতিবাদ করতে বর্তমান কমিশন কোনো ভূমিকা নেয়নি বলে এইচআরএফবি বলছে।
মানবাধিকার কমিশন থেকে যেসব বিষয়ে প্রতিবেদন চেয়ে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করা হয়আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
গত এক বছরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ৩১টি ঘটনার ক্ষেত্রে প্রতিবেদন চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা এ বছর কমিশন থেকে ২৮টি প্রতিবেদন পেয়ে তদন্তের জন্য পুলিশ অধিদপ্তরে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে গৃহকর্মী হারানো, পুলিশের টাকা দাবিসহ ছয়টির জবাব মন্ত্রণালয় কমিশনে পাঠিয়েছে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, মানবাধিকার কমিশন থেকে যেসব বিষয়ে প্রতিবেদন চেয়ে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করা হয়।
মানবাধিকার কমিশনের যে কাজ, সেটাকেই ফোকাস করতে হবে। আমি দু-একটি ঘটনায় তাদের আওয়াজ তুলতে দেখেছি। এর বেশি কিছু দেখিনি। বিচারবহির্ভূত হত্যায় তাদের কাজ দৃশ্যমান নয়কাজী রিয়াজুল হক , জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, করোনাকালে সিটি করপোরেশনকে মশকনিধনের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছে মানবাধিকার কমিশন। এ ছাড়া করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, আইইডিসিআরকে হটলাইন চালু রাখার পরামর্শ দিয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে ভার্চ্যুয়াল বৈঠক ও প্রচারাভিযান চালিয়েছে। কয়েকটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এসব ভালো উদ্যোগ। তবে মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব ও পরিধি অনেক ব্যাপক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে তাদের জোরালো ভূমিকা নেই, যা হতাশার।
এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানবাধিকার কমিশনের যে কাজ, সেটাকেই ফোকাস করতে হবে। আমি দু-একটি ঘটনায় তাদের আওয়াজ তুলতে দেখেছি। এর বেশি কিছু দেখিনি। বিচারবহির্ভূত হত্যায় তাদের কাজ দৃশ্যমান নয়।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন অনুযায়ী, কমিশন সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা তাদের সদস্যের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের ক্ষেত্রে নিজ উদ্যোগে বা দরখাস্তের ভিত্তিতে সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাইতে পারবে। সরকারকে ওই প্রতিবেদন দ্রুত কমিশনকে দিতে হবে। এ ব্যাপারে কমিশন কোনো সুপারিশ করলে তা বাস্তবায়ন করে ছয় মাসের মধ্যে কমিশনকে জানাতে হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি সত্য নয়।’
মানবাধিকার কমিশন আসলে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র হয়ে গেছে। যাঁরা কমিশনের নেতৃত্বে আছেন, তাঁদের মানবাধিকারসংক্রান্ত কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। যা করে, তা বেশির ভাগ সময়েই লোক দেখানো। যে কারণে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে নাইফতেখারুজ্জামান , ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক
করোনাকালে করোনা-সংশ্লিষ্ট বহু মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে। অথচ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি ক্ষেত্রেও সরেজমিনে কোনো তদন্তে যায়নি, এমন অভিযোগের বিষয়ে নাছিমা বেগম বলেন, ‘এটিও সত্য নয়। বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় কমিশনের তদন্ত দল গেছে।’ সিটি করপোরেশনকে মশকনিধনের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া, নাকি মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করা—কোনটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজে বেশি গুরুত্ব পাওয়া দরকার, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার মানবাধিকার। কমিশন মনে করে, তারা সময়োচিত কাজটি করেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয় বলে গত বছরের ডিসেম্বরে এক অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। কমিশন গঠনে স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের সুপারিশ করেছে তারা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মানবাধিকার কমিশন আসলে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র হয়ে গেছে। যাঁরা কমিশনের নেতৃত্বে আছেন, তাঁদের মানবাধিকারসংক্রান্ত কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। যা করে, তা বেশির ভাগ সময়েই লোক দেখানো। যে কারণে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।