সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু হওয়া একসময় অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। মাতৃমৃত্যু এখন আর কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। মাতৃমৃত্যুর ঘটনার খবর শুনলেই প্রশ্ন ওঠে, কেন মৃত্যু হলো? গত ৫০ বছরে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমেছে। তবে কমানোর সুযোগ আরও আছে। চেষ্টাও চলছে।
পেশাজীবী সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সময় বদলে গেছে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কোনো মায়ের মৃত্যু হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু ৪০-৫০ বছর আগে এটা নিয়ে এত আলোচনা হতো না। তখন মাতৃমৃত্যুর ঘটনা বিস্ময়ের বিষয় ছিল না।’
জনস্বাস্থ্যবিদেরা ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কোনো নারীর প্রাণহানি ঘটলে তা মাতৃমৃত্যু বলে বিবেচিত হয়। গর্ভধারণজনিত জটিলতার কারণে, প্রসবকালে এবং প্রসব-পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে প্রাণহানি ঘটলে তা মাতৃমৃত্যু। এক লাখ গর্ভধারণে নারী মৃত্যুর সংখ্যাকে মাতৃমৃত্যুর হার হিসেবে ধরা হয়।
সরকার বলছে, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার ১৬৫। অর্থাৎ এক লাখ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বর্তমানে ১৬৫ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। স্বাধীনতার সময় এই হার ছিল অনেক বেশি। অনেকে মনে করেন, সংখ্যাটি ছিল ৬০০-র কাছাকাছি।
১৯৭১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার কত ছিল, এর সঠিক উত্তর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানা যায়নি। অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘তখন এই ধরনের বিষয়ে তথ্য রাখা হতো না বা জানার চেষ্টা ছিল না। এই সচেতনতা আসে আরও অনেক পরে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে ১৯৯০ সাল থেকে মাতৃমৃত্যুর পরিসংখ্যান আছে। অধিদপ্তর বলছে, ১৯৯০ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৫৭৪। প্রতি দশকে এই হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০০১ সালে ৩৮৪ এবং ২০১৫ সালে ১৭৬।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই ধরনের কারণে দেশে মাতৃমৃত্যু কমেছে। নারী অধিকার, নারীর শিক্ষায় দেশ এগিয়েছে। তাতে সচেতনতা বেড়েছে। অন্যদিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতা দিন দিন বেড়েছে। প্রসব-পূর্ব, প্রসবকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী সেবার পরিমাণ ও পরিধি বেড়েছে অনেক। এসব কিছু মাতৃমৃত্যু কমাতে ভূমিকা রেখেছে। সরকারের কাজে সহায়তা করেছে জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা, বিভিন্ন দাতা সংস্থা, এনজিও, সর্বোপরি পেশাজীবী সংগঠন।
এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বেশ কিছু উদ্যোগ নারী তথা মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতিতে ভূমিকা রাখে। নাইরোবি, কায়রো, বেইজিং সম্মেলনে নারীর স্বাস্থ্য, নারীর শিক্ষা, নারীর অধিকার বিষয়ে নানা ধরনের বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সব সিদ্ধান্ত পরবর্তী সময়ে নানাভাবে দেশের আইন ও নীতি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। নিরাপদ মাতৃত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলার কাজ যেমন শুরু হয়, একইভাবে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতিতে সারা দেশে কাজ করছে। সাধারণভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে মাতৃস্বাস্থ্যসেবার কাজ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে এই সেবাদানের কাজ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
দুই অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, মাতৃমৃত্যু কমাতে তিনটি প্রধান বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়: অনিরাপদ গর্ভধারণ পরিহার, নিরাপদ প্রসব ও জরুরি প্রসূতি সেবা। তিনটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে বিশেষ উন্নতি করেছে।
নিরাপদ গর্ভধারণের সঙ্গে মোট প্রজননহার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট-টিএফআর) ও জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহারের সম্পর্ক আছে। স্বাধীনতার সময় দেশের টিএফআর ৬-এর বেশি ছিল। এখন তা ২ দশমিক ৩। স্বাধীনতার সময় খুব কমসংখ্যক দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এখন ৬০ শতাংশের বেশি দম্পতি তা ব্যবহার করেন।
গর্ভধারণের শুরু থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হলে প্রসব নিরাপদ হয়, মাতৃমৃত্যু কমে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, প্রসব-পূর্ব সেবা দিন দিন বাড়ছে। ২০০১ সালে ৪০ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা প্রসব-পূর্ব সেবা পেতেন। ২০১৬ সাল তা বেড়ে ৭৮ শতাংশে দাঁড়ায়।
সাধারণভাবে বলা হয়, প্রসবে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা থাকলে মাতৃমৃত্যু কম হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ২০০০ সালে ১২ শতাংশ প্রসবে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পাওয়া যেত। আর বর্তমানে এই হার প্রায় ৫০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মাতৃমৃত্যু কমানোর জন্য তাঁরা বেশ কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। এর মধ্যে আছে জরুরি প্রসূতি সেবা কার্যক্রম; ডিমান্ড সাইড ফাইন্যান্সিং (ডিএসএফ) মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিম, কমিউনিটি স্কিলড বার্থ অ্যাটেনডেন্ট প্রশিক্ষণ, প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ প্রতিরোধ কর্মসূচি; মাঠপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের রক্তক্ষরণের কারণে মাতৃমৃত্যু রোধ কার্যক্রম; মাসিক নিয়মিতকরণ ও গর্ভপাত-পরবর্তী সমন্বিত সেবা; অবসটেট্রিক্যাল ফিস্টুলা রিপেয়ার কার্যক্রম। একই ধরনের কার্যক্রম পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
তারপরও এক লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে দেশে ১৬৫ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। এসব মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ। প্রতিবছর যত মাতৃমৃত্যু ঘটে, তার ৩১ শতাংশের পেছনে আছে প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ। আর ২৪ শতাংশ মৃত্যু হয় খিঁচুনির কারণে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মা ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির পরিচালক মোহাম্মদ শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাতৃমৃত্যু কমানো বড় ধরনের অর্জন ঠিকই, তবে আরও কমানো সম্ভব। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে একজন মায়ের মৃত্যুও কাম্য নয়।’