বাঁশের তৈরি মাচা। সে মাচার ওপর স্তরে স্তরে ৩২টি ট্রে সারি বেঁধে পাতা। ট্রেগুলোতে এক ছটাক মাটিও নেই। অথচ প্রতিটি ট্রে থেকে দিনে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৯ কেজি ঘাস। কীটনাশক ও পরজীবীমুক্ত সেই ঘাস খেয়েই খামারের গবাদিপশুর নিরাপদ খাদ্য যেমন নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনি দুধের উৎপাদনও গেছে বেড়ে।
এভাবে মাটি ছাড়াই ঘাস চাষ করছেন রাজধানীর কল্যাণপুরের খামারি মাহবুব উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। তাঁর খামারে আছে ২২টি গাভি। বাজারে পাওয়া গবাদিপশুর খাবার কিংবা সাইলেজ খাবারের চেয়ে মাটি ছাড়া ঘাস গাভিকে খাওয়ালে ভালো মানের দুধ পাওয়া যায় বলে জানান তিনি। বললেন, ‘আমি এক বছর ধরে এভাবে ঘাস উৎপাদন করছি। ফলে আমার গরুগুলোর স্বাস্থ্যও ভালো আছে। দুধের উৎপাদনও বেড়েছে। আমি তো ক্রেতাদের এই দুধ সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছি।’
খামারি মাহবুব উদ্দিন জানান, গবাদিপশুকে হাইড্রোপনিক ঘাস খাওয়ানোর পর থেকে তাঁর খামারের দুধ উৎপাদন বেড়েছে ১৫ শতাংশ। আগে যে গাভি থেকে দিনে ১০ লিটার দুধ মিলত, এখন সেই গাভি দিনে ১২ লিটার পর্যন্ত দুধ দিচ্ছে। পশুর কৃত্রিম প্রজনন ক্ষমতাও বেড়েছে। তবে ভালো মানের ঘাস পেতে খামারিদের ভালো মানের ভুট্টার বীজ ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে আনেন। সে বছরের ১৭ মে থেকে বিভিন্ন সেমিনার ও কর্মশালা করে আগ্রহী খামারিদের কাছে এই প্রযুক্তি হস্তান্তর শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৬৫ জন খামারি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং ১৫ জন খামারি এই পদ্ধতিতে ঘাস উৎপাদন করছেন। বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় খামারি মাহতাব উদ্দিন নিজেই তাঁর খামারে মাটিহীন ঘাস উৎপাদন করছেন।
খামারিরা জানিয়েছেন, বাজারে প্রচলিত খড়, চিটাগুড় ও ইস্টমিশ্রিত গবাদিপশুর খাবার সাইলেজের দাম পড়ে কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা। গবাদিপশু মোটাতাজা করতে অনেকে সেই খাবারের সঙ্গে ক্ষতিকর হরমোন ও স্টেরয়েড মিশিয়ে থাকেন। অথচ হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে প্রতি কেজি মাটিহীন ঘাসের উৎপাদন খরচ পড়ছে নন–এসি পদ্ধতিতে ৫ থেকে সাড়ে ৫ টাকা এবং এসি পদ্ধতিতে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকা।
গবাদিপশুর খাবার হিসেবে হাইড্রোপনিক ঘাস খুবই উপকারী বলে জানিয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক আনয়ারুল হক বেগ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কীটনাশক, কৃমি ও পরজীবীমুক্ত উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ হাইড্রোপনিক ঘাস খেয়ে গবাদিপশু ভালো মানের দুধ দেবে। বাজারে পাওয়া গরুর খাবার বা ঘাসে অনেক সময় কীটনাশক, পোকামাকড় থাকে। তাতে পশু পুষ্টি কম পায়, উৎপাদনও কম হয়। কিন্তু হাইড্রোপনিক ঘাস খনিজ পদার্থ ও নিউট্রিয়েন্টসমৃদ্ধ, একই সঙ্গে ফাঙ্গাস ও ছত্রাকমুক্ত।
মাটিহীন ঘাস চাষে খামারিদের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছেন বিসিএসআইআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করিম। তিনি বলেন, চীন থেকে আনা ট্রে এবং এসি পদ্ধতিতে হাইড্রোপনিক ঘাস উৎপাদন কিছুটা ব্যয়বহুল। তবে কোনো খামারি চাইলে অবশ্য একদম কম খরচেও এই পদ্ধতিতে পশুর খাবার উৎপাদন করতে পারবেন। সেই সফল উদাহরণও আছে। তবে দেশের খামারিদের এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘাস উৎপাদন সম্পর্কে আরও জানা উচিত।
যেভাবে ঘাস চাষ হয়
বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ইট, টিনের তৈরি বা আলো–বাতাসসমৃদ্ধ যেকোনো ঘরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) বা নন–এসিতে এই
প্রযুক্তি স্থাপন করা যাবে। সেই ঘরে ড্রয়ার পদ্ধতি বা দেশীয় পদ্ধতিতে বাঁশের তৈরি মাচায় প্রথমে ট্রে বসাতে হয়। এসব ট্রে চীন থেকে আমদানি করে আনতে হয় বা দেশীয় মুরগির খামারে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ট্রেতেও কাজ চলে। গম, ভুট্টা বা বার্লি যেকোনো একটির ভালোমানের বীজগুলো এক দিন পানিতে ভিজিয়ে পরে জাগ দিয়ে মাচার ট্রেগুলোতে পাতা হয়। কক্ষের তাপমাত্রা রাখতে হয় ২২ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর পানি সঞ্চালন পদ্ধতিতে ৮ দিনে বীজ থেকে জন্মানো ঘাসগুলো প্রাণীর খাওয়ার উপযোগী হয়। প্রতি কেজি ভুট্টার বীজ থেকে ৫ থেকে ৭ কেজি ঘাস হয়। প্রতি ৩০০ বর্গফুট জায়গায় ৮০টি ট্রে রাখলে দিনে ১৫০ কেজি মাটিহীন ঘাস উৎপাদন সম্ভব। ম্যাট আকারে সে ঘাস তুলে গবাদিপশুকে খাওয়াতে হয়।
বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা মাটিহীন ঘাস চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষক ও খামারিদের সব ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আকারে প্রযুক্তিটি স্থাপনে প্রায় ৩ লাখ টাকা লাগবে। তবে প্রযুক্তিটির কারিগরি জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কোনো খামারি নন–এসি পদ্ধতিতে ২০ হাজার টাকা খরচ করে মাটিহীন ঘাস চাষ করতে পারবেন।